খবর৭১ঃ
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে সামনে রেখে গত মাসে ঢাকায় বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞদের একটি মিলনমেলা বসেছিল। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার ভ্রাতৃপ্রতিম তিনটি লিভার সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার প্রায় পঞ্চাশ জন লিভার বিশেষজ্ঞ আর সাথে সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমার এদেশীয় সহকর্মীরা।
‘শতবর্ষের পথে বঙ্গবন্ধু – গর্বিত বাঙালির জয়যাত্রা’ এই উপজীব্যকে ধারণ করে বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞদের যা কিছু অর্জন, বিশ্ববাসীর সামনে তা তুলে ধরার মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে তার জন্ম শতবর্ষে অভিবাদন জানাতে ‘প্রথম পদ্মা-গঙ্গা-গোমতি লিভার সম্মেলন’-কে কেন্দ্র করে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন এপার-ওপার তিন বাংলার তাবৎ নামকরা লিভার বিশেষজ্ঞ। ‘জয় বাংলা বাংলার জয় … …’ দিয়ে সম্মেলনের সূচনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারও আগে তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত বত্রিশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবকের মাধ্যমে দু’দিনব্যাপি আনুষ্ঠানিকতার শুরু।
অনেকের জন্যই এটাই প্রথম বত্রিশ যাত্রা। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সিইও মাশুরা আপার আবেগঘন ব্রিফিং শেষে বত্রিশের কড়িডোরে-কড়িডোরে যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরা, বারবার মনে হচ্ছিল কি ভাবছিলেন তখন শেখ রাসেল। পরিবারের সবাই যখন নিরব-নিথর, বত্রিশে শেষ গুলির আওয়াজটি শোনার পর যখন প্রায় একটি ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এইতো পাশেই গার্ডরুমে গৃহপরিচারকদের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে কি ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছিল দশ বছরের একটু বেশি এই ছোট্ট হৃদয়ে। ঐ ষাটটি মিনিট আর তিনশ ষাটটি সেকেন্ড না জানি অনন্তকালের চেয়েও দীর্ঘতর মনে হচ্ছিল তার কাছে। হয়ত ভেবেছেন পরের সেকেন্ডটি অন্যরকম হবে। হয়ত সত্যি তাকে নিয়ে যাওয়া হবে তার প্রিয় হাসু বুবুর কাছে। তারপর একসময় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে তার বত্রিশের দোতালায় যাত্রা। কি ভেবেছিলেন কি জানি। পথে সিঁড়িতে দেশের পিতার রক্তাক্ত, নিথর দেহ। পিতার রক্ত মাড়িয়ে অনন্তের পথে তার সেই যাত্রা!
পৃথিবীতে খুব অল্প সময় কাটিয়েছিলেন শেখ রাসেল। গুনে-গুনে দশটি বছর আর অল্প ক’টি মাস। তারপর পেরিয়ে গেছে তারচেয়েও অনেক বেশি, অনেকগুলো বছর। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে চারগুণেরও বেশি। পনের আগস্ট না ঘটলে আজ মধ্য পঞ্চাশে পা রাখতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবার পরে পৃথিবীতে আগমন তার, কিন্তু প্রস্থান সবার আগে। খুব অল্পসময়ই তিনি কাটাতে পেরেছেন এদেশের ধুলো-মাটির সান্নিধ্যে।
পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় এদেশ দেখেছে অনেক, বদলেছে তারচেয়েও বেশি। পঁচাত্তরের ঘাতকের ফাঁসি দেখেছে বাংলাদেশ, দেখেছে লাফিয়ে-লাফিয়ে তার প্রিয় হাসু বুবুর হাত ধরে উপরে উঠতে উন্নয়নের সূচক। প্রায়ই গানটা বাজতে শুনি, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত … …’। শুনি আর ভাবি যে পরিবারের প্রতিটি সদস্য তাদের মেধা আর আত্মত্যাগে আবদ্ধ করেছেন গোটা জাতিকে তাদের এই কনিষ্ঠতম সদস্যটি আজ মধ্য পঞ্চাশে আমাদের পাশে থাকলে আমরা কোথায় থাকতাম। বঙ্গবন্ধুতো বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন পঞ্চাশের আগেই আর পঞ্চাশ পেরুতে না পেরুতেই জাতির পিতা।
শেখ রাসেলের অগ্রজ শেখ কামাল পেরুতে পারেননি পচিশের কোটাও। অথচ এরই মাঝে কমিশন নিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। ছাত্রলীগের রাজনীতি করবেন বলে ছেড়েছিলেন উর্দি, দায়িত্ব নিয়েছিলেন পরিবেশ রক্ষার। জন্ম দিয়েছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এনেছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া। স্বাধীন দেশের প্রথম মঞ্চ নাটক কিংবা বিটিভি’র প্রথম ধারাবাহিক নাটক, সেখানেও সেই শেখ কামালই। আর অন্য অগ্রজও শেখ জামাল – তিনিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন কমিশন্ড অফিসার আর তারপর স্যান্ডহার্স্টের মত বিশ্ব সেরা মিলিটারি অ্যাকাডেমির ক্যাডেট।
সাতই মার্চ রেসকোর্সে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠার আগে বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবের পরামর্শ নিয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন কি বলবেন তিনি উন্মুখ জাতির উদ্দেশ্যে। জ্বরে তখন বঙ্গবন্ধুর গা পুড়ে যাচ্ছিল। চাপে ছিলেন নানা মুনির, মত ছিল নানা রকমের। বঙ্গমাতা তাকে বলেছিলেন নিজের ভেতরের কথা শুনতে। বঙ্গবন্ধু সেদিন করেওছিলেন তাই। ফলাফলটা স্পষ্ট। মানবজাতি পেয়েছে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ আর আমরা আমাদের সবুজ পাসপোর্ট। এই ছিল এদেশের জন্য এই পরিবারের গৃহকত্রীর অসংখ্য-অজস্র অনুচ্চারিত অবদানের একটি উদাহরণ।
একবার ভাবুনতো, এমন পরিবারের যিনি উত্তরাধিকার, সেদিন যদি ঘাতকের দল শেষ মুহূর্তে তাকে চিনতে না পারত, আজ যদি তিনি থাকতেন আামাদের মাঝে, শেখ হাসিনার পাশে তার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য, কোথায় দাঁড়াতে পারত আজকের বাংলাদেশ? সেই বাংলাদেশকে কল্পনা করার শক্তি আমার নেই। শুধু জানি মধ্য পঞ্চাশের একজন শেখ রাসেলের আজ শেখ হাসিনার পাশে প্রয়োজন ছিল খুব বেশি।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যটিকে হত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের তালিকাটিকে প্রলম্বিতই করেনি বরং তারা বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষকে বঞ্চিত করেছে আরো তাড়াতাড়ি আরেকটু এগিয়ে যাওয়া থেকে। পঁচাত্তরের সামনের সারির ক্রীড়ানকদের বিচার আমরা দেখেছি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে পঁচাত্তরের নেপথ্যের কুশীলবরা। একটি বিশেষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এদের চিহ্নিত করে, আইন সংশোধন করে হলেও প্রয়োজনে মরণোত্তর বিচারের আওতায় আনা আজ তাই শুধু বাঙালির দাবি-ই নয়, বরং অধিকার।