ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে মোবাইল টাওয়ার অপসারণঃ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

0
491
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে মোবাইল টাওয়ার অপসারণ

খবর৭১ঃ

মোবাইল ফোন কম্পানির টাওয়ার থেকে বেরোনো উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় (রেডিয়েশন) বিকিরণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সব স্পর্শকাতর স্থান থেকে মোবাইল টাওয়ার দ্রুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

আজ বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত রায় প্রদানকারী বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে স্পর্শকাতর জায়গা বলতে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়াও হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজকে বোঝানো হয়েছে।

২০১৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে হাইকোর্টকে জানানো হয়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কম্পানির টাওয়ার থেকে বেরোনো তেজস্ক্রিয় (রেডিয়েশন) বিকিরণ উচ্চমাত্রার। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ প্রেক্ষাপটে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ওই বছরের ২৮ মার্চের মধ্যে আদালতকে জানাতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র (এইচআরপিবি) করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন খন্দকার রেজা-ই-রাকিব।

হাইকোর্টের নির্দেশনার পর গঠিত কমিটি মতিঝিল, গুলশান ও মিরপুর এলাকায় ছয়টি মোবাইল কম্পানির ১৮টি টাওয়ারের (প্রতিটির তিনটি করে) তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মাপে। এসব টাওয়ারের মধ্যে মাত্র একটিতে মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায় বলে সাবকমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি যে সুপারিশ তুলে ধরে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আদালতে উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে রেডিয়েশনের মাত্রা তুলে ধরা হয়।

এরপর আদালত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করতে স্বাস্থ্য সচিবকে নির্দেশ দেন। ওই কমিটিতে বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধিদের রাখতে বলা হয়। এ কমিটিকে মোবাইল টাওয়ার থেকে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারগুলো থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

সেই রুলের দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ২৫ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সমীক্ষা করে দেশের টাওয়ারগুলোর ক্ষতিকর রেডিয়েশনের বিষয়ে আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদন দেখে আদালত ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়ানো মোবাইল টাওয়ার অপসারণের বিষয়ে আদেশ দেবেন বলেও মন্তব্য করেন আদালত।

একইসঙ্গে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর বিকিরণের (রেডিয়েশন) বিষয়ে সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের পাশাপাশি ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

আদালতের দেওয়া ১১ দফা নির্দেশনায় যা রয়েছে- ১। মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১/১০ ভাগ করা, ২। মোবাইল টাওয়ার বাসার ছাদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কারাগার, খেলার মাঠ, জনবসতি এলাকা, হেরিটেজ ও প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাসহ ইত্যাদি স্থানে না বসানো এবং যেগুলো বসানো হয়েছে তা অপসারণ, ৩। বিকিরণের মাত্রা যেন বেশি না হয়, তার ব্যাপারে অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, ৪। টাওয়ার বসাতে জমি অধিগ্রহণে কোনও বাধা আছে কিনা বা বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ, ৫।  টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা বিটিআরসি এবং লাইসেন্সি দুপক্ষকেই স্বাধীনভাবে আইটিইউ এবং আইইসি এর মান অনুসারে পরিমাপ করা, ৬। কোনও টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে তা অপসারণ করে নতুন টাওয়ার বসানো, ৭।  টাওয়ার ভেরিফিকেশন মনিটর পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিটিআরসির দায়-দায়িত্ব হবে বাধ্যতামূলক, ৮। বিটিআরসি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠন করবে, ৯। বিটিআরসি অন্যদের নিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি গঠন করবে। লাইসেন্সিকে প্রতি ছয় মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে, ১০। মোবাইল সেটে দৃশ্যমানভাবে এসএআর মান লিখতে হবে এবং ১১। সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সি প্রতিটি রিপোর্ট/রেকর্ড পাঁচ বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করবে। সংশ্লিষ্ট অথরিটিকে আদালতের আদেশ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে আরও গবেষণা করে রিপোর্ট দিতে হবে।

এর আগে মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশন নিঃসরণ নিয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করে এইচআরপিবি। আদালত রেডিয়েশনের মাত্রা এবং এর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন মোবাইল কম্পানির কয়েকটি টাওয়ার পরিদর্শন করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে সাত দিনের মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করতে স্বাস্থ্যসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই কমিটিতে বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধিসহ সাতজন সদস্য রাখতে বলেন আদালত। এ কমিটিকে মোবাইল টাওয়ার থেকে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এসব অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করা হয়। তাতে টাওয়ারগুলো থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here