শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় সরাসরি অংশ নেয় খালেদই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক

0
533
শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় সরাসরি অংশ নেয় খালেদই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ছবিঃ সংগৃহীত

খবর৭১ঃ

রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ঢাকার জুয়ারিদের কাছে ‍যিনি ক্যাসিনো খালেদ হিসেবে পরিচিত। এই জুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে তার অপরাধ জগত সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেরিয়ে আসছে তার অতীতের সব অপরাধ।

ফ্রিডম পার্টির নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া সবশেষ যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবদলে যোগ দেন। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে পল্টি নেন। রাতারাতি বনে যান প্রভাবশালী যুবলীগ নেতায়। এই খালেদই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় তিনি সরাসরি জড়িত। তবে মৃত দেখিয়ে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। পরে জানা যায়, খালেদ মারা যাননি।

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা হয়। ওই হামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহম্মদ মানিক, সৈয়দ নাজমুল মাহমুদ মুরাদ এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ সরাসরি অংশ নেয়।

এ ঘটনার ৮ বছর পর মানিক-মুরাদের সঙ্গে খালেদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে সূত্রাপুর থানার একটি হত্যা মামলার সূত্র উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘খালেদ’ মারা গেছেন। কখন, কীভাবে সে মারা গেছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

এমনকি খালেদের পিতার নাম, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া গেছে বলা হলেও অভিযোগপত্রে এসব তথ্য নেই। খালেদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মোহাম্মদ আলীও যুগান্তরকে বলেছেন, ওই হামলায় খালেদ সরাসরি অংশ নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর ২২ বছর পর অভিযোগ উঠল, হামলায় জড়িত খালেদ মারা যাননি। ওই মামলার বিচারকার্যও শেষ হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে এই মামলার রায়ে খালেদের সন্ত্রাসী দুই সহযোগী মানিক-মুরাদসহ ১১ জনের ২০ বছর করে সাজা হয়েছে।

সময়ের পরিক্রমায় খালেদ ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াই সেই খালেদ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সে ভোল পাল্টে যুবলীগের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তাকে আশ্রয় দেন যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। অর্থ ও ক্ষমতার জোরে যুবলীগের বড় পদও বাগিয়ে নেয়। পরে সেই ‘মৃত’ খালেদই নগরবাসীর জন্য ভয়ংকর আতঙ্কে পরিণত হয়। আর এভাবেই ভয়ংকর উত্থান ঘটে ‘মৃত’ খালেদের।

খালেদকে মৃত দেখিয়ে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে সংস্থাটি।

এ ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে বলেও একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন। র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পরিকল্পিতভাবেই মামলার অভিযোগপত্র থেকে খালেদকে মৃত দেখানো হয়েছে। অভিযোগপত্রে নাম না থাকায় তার বিচারও হয়নি।

খালেদের বাবা মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘তদন্ত এখনও সম্পন্ন হয়নি। শেষ হলে আমরা বিস্তারিত জানাতে পারব। এখনই এ বিষয়ে হ্যাঁ বা না বলার সময় আসেনি।’

খালেদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মোহাম্মদ আলী বর্তমানে পলাতক। তিনি টেলিফোনে বলেন, ‘ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে হামলায় আমার ওস্তাদই তো (খালেদ) ছিলেন। তিনি যে ওই হামলায় জড়িত ছিল এটা আমরা জানি।’ তিনি বলেন, একদিন খালেদের বাবা আইনজীবী মান্নান ভূঁইয়া আমাকে বলছিলেন, ‘আমি যদি আইনজীবী না হতাম তবে খালেদের এসব মামলা কী গায়েব করতে পারতাম। আমি যখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলাম, সব ফাইল গায়েব করে দিছি।’ আমি বললাম, খালু একটু কনতো ফাইল গায়েব করে ক্যামনে। তখন তিনি বলেন, ‘তুমি উকিল হলে বুঝতা। বিএনপি ক্ষমতায় আসুক তোমাকে বুঝামু।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালেদের বাবা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘এসব কথা ভিত্তিহীন। তখন খালেদ নবম শ্রেণিতে পড়ত। সে কীভাবে ফ্রিডম পার্টি করে। এসব কথা কোথা থেকে আসে কীভাবে আসে বুঝতে পারি না। নথি গায়েব এমন কোনো কিছু নেই।’

খালেদের সহযোগী আলীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘সে পালিয়ে চলে গেছে। পূর্বাচল থেকে পালিয়ে গেছে। এগুলো বলে তো আর লাভ নেই। আলী তার নাম। সে ক্রিমিনাল কেসের আসামি। সে অবৈধভাবে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছে।’

শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, আমরাও শুনেছি খালেদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াই যে সেই খালেদ সেটা জানা ছিল না। সে কীভাবে দলে অনুপ্রবেশ করেছে তা তদন্ত হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে অপসারণের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যুবলীগ নেতাদের বিষয়েও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, যুবলীগের এক নেতা অস্ত্র উঁচিয়ে চলে। আরেকজন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়।

এর পর গণমাধ্যমে যুবলীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতায় ঢাকার ৬০টি জায়গায় ক্যাসিনো পরিচালনার খবর প্রকাশ হয়। ১৮ নভেম্বর ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস, ওয়ান্ডারার্স এবং গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ মদ ও ৪০ লাখের বেশি টাকা উদ্ধার করে র্যা ব। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে ওই দিনই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ইয়াংমেনস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

যেভাবে আসে খালেদের নামঃ

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িতরা ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হামলার আগে ধানমণ্ডির ফ্রিডম পার্টির অফিসে গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুখ রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ। ওই বৈঠকে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক, মুরাদ, তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদসহ ২০ জন উপস্থিত ছিল।

পরে হামলায় মানিক, মুরাদ, খালেদসহ ১২ জন ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার বাসায় দুটি ট্যাক্সিযোগে হামলা করে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্তদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ ওরফে খালেক ওরফে খালেদ অলিভী এবং শহিদুল ওরফে খোকন মারা যাওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here