আবরার হত্যাকাণ্ডঃ ২০ জনকে আসামি করে চার্জশিট হচ্ছে!

0
461
২০ জনকে আসামি করে চার্জশিট হচ্ছে
ছবিঃ যুগান্তর

খবর৭১ঃ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ২০ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে। আদালতে দেয়া বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ৬ নেতার জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে তাদের নাম এসেছে। এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

ওই ৬ নেতার জবানিতে আরও অনেকের নাম এসেছে, যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। কৌতূহলবশত ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তাদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। পরিকল্পনাকারী এবং নির্দেশদাতাদেরও আসামি করা হচ্ছে।

এরই মধ্যে ছাত্রলীগের সিক্রেট মেসেঞ্জার গ্রুপ, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা এবং ১৬১ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মশারি টানানোর রড-স্টাম্প, খুনিদের কল রেকর্ড এবং মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথন আলামত হিসেবে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে ফরেনসিক টেস্ট ও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা মঙ্গলবার উল্লিখিত সব তথ্য জানিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আবরার হত্যার ঘটনায় আর কোনো আসামিকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়ার ইচ্ছা পুলিশের নেই। তবে সাক্ষীর মধ্যে থেকে ২-১ জনকে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আওতায় আনা হতে পারে।

এদের মধ্যে আশিকুল ইসলাম বিটু নামের একজনকেও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। স্বীকারোক্তি দেয়ার বাইরে যাদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই তাদের অপরাধ প্রমাণ করা হবে।

এদিকে মঙ্গলবার দিনাজপুর থেকে এজাহারভুক্ত আসামি এসএম নাজমুস সাদাতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিন মনিরুজ্জামান মনির নামে এক আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আরেক আসামি আকাশ হোসেনকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে শামসুল আরেফিন রাফাতকে আরও ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

সিক্রেট মেসেঞ্জার গ্রুপ পর্যালোচনা করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন আবরারকে নির্যাতনের নির্দেশ দেন ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন।

৫ অক্টোবর শনিবার বেলা পৌনে ১টায় ১৬তম ব্যাচকে ম্যানশন করে রবিন লিখেন, ‘সেভেনটিনের আবরার ফাহাদকে মেরে হল থেকে বের করে দিবি দ্রুত। দু’দিন টাইম দিলাম।’

পরদিন রোববার রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে সবাইকে হলের নিচে নামার নির্দেশ দেন মনিরুজ্জামন মনির। রাত ৮টা ১৩ মিনিটে আবরারকে নিজ কক্ষ থেকে ডেকে করিডর দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে নিয়ে যান সাদাত, তানিম এবং বিল্লাহসহ কয়েকজন। রাত ১টা ২৬ মিনিটে ইফতি মোশাররফ সকাল মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘মরে যাচ্ছে। মাইর বেশি হয়ে গেছে।’

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছে, রাত ১২টা ২৩ মিনিটে আশিকুল ইসলাম বিটু ২০১১ নম্বর কক্ষের দিকে হেঁটে যায়। অমিত সাহার ওই রুমেই আবরারের ওপর শুরু হয় নির্যাতনের স্টিমরোলার। বিটু ওই রুমে যাওয়ার ৭ মিনিট পর বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় তার সঙ্গে কোনো কিছু না থাকলেও বেরিয়ে আসার সময় দেখা গেছে, তিনি একটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন।

এ বিষয়ে বিটুকে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দাদের তিনি বলেন, আবরারকে ডেকে আনতে প্রথমে মনিরের ওপর নির্দেশ আসে। পরে জেমি ও তানিমকে ফোন দিয়ে বলা হয়, আবরারকে ডেকে ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে আন।

তাকে ওই রুমে নেয়া হলে দু’জন আবরারের দুটি ফোন এবং একজন তার ল্যাপটপ সার্চ করে দেখছিল। আবরারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গিয়ে লাইক-কমেন্টস দেখা হচ্ছিল। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, আবরার রুমের ভেতর শুয়ে আছে। আমি সকালকে প্রশ্ন করি, আবরারের এ অবস্থা কীভাবে হল? তাকে কে এভাবে মেরেছে? তখন মনির উত্তর দেয়, ‘অনিক ভাই বেশি মেরেছে।’

একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও কেন আবরারকে নির্যাতনের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনকে জানাননি বিটু? এ প্রশ্নের উত্তরে কোনো সদুত্তর নেই তার। বলেন, আমি মনে করেছিলাম, অনেক মারধর করা হলেও ঢাকা মেডিকেলে নিলে সে ঠিক হয়ে যাবে। আমি গিয়ে তাকে মারা যাওয়া অবস্থায় দেখিনি। হলে এ রকম নির্যাতন প্রায়ই হয়। এ কারণে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেইনি।

এদিকে যার রুমে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এখনও নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেননি। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ২০১১ নম্বর রুমে আমি থাকি, ইফতি মোশাররফ সকাল থাকে, মোস্তফা রাফির থাকে। এ কারণেই আমার নামটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছে। তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে অমিত সাহার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই তাকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে।

ডিবি সূত্র জানায়, চার্জশিটে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে মোজাহিদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনির, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, এএসএম নাজমুস সাদাতসহ আরও অন্তত ১০ জন রয়েছে। ওই সূত্রটি জানায়, রবিন, অনিক এবং সকালকে গ্রেফতার করতে না পারলে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়ে যেত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মঙ্গলবার বলেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ২০ বা ততোধিকের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি।

সবাইকে ১৬৪ ধারার আওতায় আনা যাচ্ছে না। যারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিচ্ছে না তাদের বিষয়টি প্রযুক্তির সহযোগিতায় প্রমাণ করা হবে। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনের নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আমরা ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছি। তাছাড়া মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও তদন্তে আসায় আরও ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজাহারে থাকা ১৯ জন এবং এর বাইরে গ্রেফতার হওয়া ৪ জনসহ মোট ২৩ জনকে নিয়েই বিচার বিশ্লেষণ চলছে। তাদের মধ্য থেকে চার্জশিটে ২-১ জন বাদ যেতে পারে।

তবে যারা ১৬৪ ধারা করেছে এবং এজাহারের বাইরে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সবার নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যে দু-একজনের নাম বাদ যাবে তাদের নাম এজাহারে থাকলেও তদন্তে এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম কমিশনার বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ মুহূর্তে ৬ জন ডিবি হেফাজতে আছেন। গ্রেফতারকৃত বাকিরা কারাগারে আছেন। তিনি বলেন, আস্তে আস্তে তদন্ত কাজ গুটিয়ে আনছি। জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছি।

এদিকে আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এএসএম নাজমুস সাদাতকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার কাটলা বাজার এলাকা থেকে মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী।

গ্রেফতারকৃত এএসএম নাজমুস সাদাত জয়পুরহাট জেলার কালাই থানার কালাই উত্তর পারার হাফিজুর রহমানের ছেলে। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য তিনি দিনাজপুর জেলার হিলি বর্ডার দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।

মঙ্গলবার ভোররাতে সীমান্তবর্তী একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা) কর্মরত রফিকুল ইসলামের বাড়ি থেকে নাজমুস সাদাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে সকালেই তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় ডিবি পুলিশের সদস্যরা।

পুলিশ জানিয়েছে, রফিকুল ইসলামের বাড়িটি একই সঙ্গে বাড়ি ও এনজিওর কাজে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকেই আসামিকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বিরামপুর থানার পরিদর্শক (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, আটকের পরপরই আসামিকে ঢাকায় নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ।

এছাড়া মঙ্গলবার তিন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে মনিরুজ্জামান মনির হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

রিমান্ডে থাকা আরেক আসামি আকাশ হোসেনকে একই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এই আদালতে শামসুল আরেফিন রাফাদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে সামছুল আরেফিন রাফাতের চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। এর আগে সোমবার উল্লিখিত তিন আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হয়।

 

সূত্রঃ যুগান্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here