শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধের উপায় কী

0
598
শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধের উপায় কী

খবর৭১ঃ রাজধানীর সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সাদিক সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছেন। কারণ হিসেবে পুলিশ বলেছে, সাদিক শারীরিকভাবে মোটা ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন এবং আসন্ন পরীক্ষায় ফলাফল নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

সবমিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। একপর্যায়ে পুলিশ কর্তা বাবার পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। শুধু সাদিকই নয়, প্রায়ই স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে কিশোররা আত্মহত্যা করছেন, আর শিশুরা ভুগছেন নানান মানসিক সমস্যায়।

এসবের বেশিরভাগই ঘটছে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা থেকে হতাশা, বিষণ্ণতা, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপ নিতে না পেরে। কিন্তু শিশু-কিশোররা যেন হতাশা, বিষণ্ণতায় না ভোগে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা না করে, সেসব নিয়ে দেশে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ বা সচেতনতা কার্যক্রম। ফলে শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা কমছে না।

সারা বিশ্বের মতো ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়েছে বাংলাদেশেও। এ দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন’। কিন্তু আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বাংলাদেশের কার্যক্রম কেবল সেমিনার, র‌্যালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বা উন্নয়নে নেই তেমন কোনো কার্যক্রম। আর এর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু-কিশোররা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে অবহেলা, অপমান, কটূক্তি, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, সহিংসতা ও প্রতিযোগিতামূলক তুলনা, এসব নানা কারণে শিশু-কিশোররা হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। বলতে গেলে উল্টো কটু কথা শুনতে হয়। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুর কথা চিন্তা করে থাকে তারা। একসময় তারা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভিকারুননিসা স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার পর শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু এরপর আর কোনো কিছু হয়নি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ১৪৪ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৮ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৯৮ শিশু। ২০১৭ ও ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২১৩ ও ১৪৯। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার এই সংখ্যা সত্যিই ভয়াবহ।

শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আত্মহত্যার বহু ধরনের কারণ রয়েছে। তার মধ্যে শিশু-কিশোররা বা বয়সে তরুণরা যে আত্মহত্যা করে; তা দু’ধরনের আত্মহত্যা হতে পারে।

একটি হচ্ছে চিন্তা ভাবনা করে, অনেকদিন ধরে কষ্ট জমে থাকে মরবো, মরবো, চিন্তা করে আত্মহত্যা করে। আরেকটি হচ্ছে হঠাৎ করে আবেগের বশে বা আবেগের তাড়নায় পড়ে রাগে কিংবা অপমানে আত্মহত্যা করে।

শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার পেছনে বেশ কিছু করার উল্লেখ করেন তিনি। তাজুল ইসলাম জানান, শিশু-কিশোররা বেশিরভাগ সময় তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত হয়ে বা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, ক্ষোভে, ক্রোধে, অপমানে ও হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করে।

প্রথমত, যাদের হতাশা সহ্য করার ক্ষমতা কম। দ্বিতীয়ত, তাৎক্ষনিক আবেগতাড়িত হয়ে। তৃতীয়ত, তাৎক্ষণিক চাওয়া-পাওয়া বা বাসনা পূরণ না হওয়া। চতুর্থত, কিছু হলেই রাগের বশে যা ইচ্ছা তাই করা।

এ ছাড়াও কিছু রোগ আছে যেমন, ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি, বাইফুলারমুর্ডিজ অর্ডার, ব্যক্তিত্বের ত্রুটি। এসব কারো মধ্যে থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। আর খুব বড় ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

তবে সবাই আত্মহত্যা করে না। যাদের তিরস্কার গ্রহণের ক্ষমতা কম, হতাশা নেওয়ার ক্ষমতা কম, যারা আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করে তাদের মানসিক কাঠামোটাই দুর্বল থাকে। এখন আমরা যদি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারতাম তাহলে এই সমস্যাগুলো কমে যেত। তারা কিন্তু হঠাৎ মরতে চায় এমন নয়। তারা কষ্ট, বেদনা সহ্য করতে পারে না বলেই তা থেকে মুক্তি চায়।

তাৎক্ষণিকভাবে তাদের মনে হয় এই কষ্ট, বেদনার কোনো পরিত্রাণ নাই, এর কোনো সীমা নাই, এর কোনো সমাধান নাই। তখন তারা মনে করে এটা থেকে মুক্তির একমাত্র পথই হচ্ছে নিজেকে শেষ করে দেওয়া। তারা সাময়িক কষ্ট, বেদনার আক্ষেপ থেকে বাঁচার জন্য মরে।

বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্নভাবে ইঙ্গিত দেয়, ডাক্তারদের কাছে যায় কিংবা যারা আশেপাশে আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের বলে যে, আর পারছি না, এটা হবে না, এটা পারবো না, আমার দ্বারা হবে না, আমার জীবনের কোনো মূল্য নাই, এমন বিভিন্ন ধরনের হতাশামূলক কথা তার আবেগের একটি আকুতি জানায়; কিন্তু আমরা সেটাকে গুরুত্ব দেই না। এই কথাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, না হলে তারা মৃত্যুর মতো ঝুঁকিও বেছে নেয়।

এই থেকে মুক্তি পেতে যেসব শিশু-কিশোররা আবেগের দিক থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, হতাশাগ্রস্ত, অল্পতেই ভেঙে পড়ে, অল্পতেই রাগান্বিত, ক্রুদ্ধ, আবেগীয় সমস্যা ঘটায় তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে এবং মানসিক কাঠামোকে আরও শক্ত-সবল করতে হবে বলে মনে করেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এতে নিজের যেমন সতর্ক থাকতে হবে এবং যারা মানসিক ঝুঁকিপূর্ণ তাদেরকে প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করে এবং সাইকোথেরাপি করে স্বাভাবিক করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এই অধ্যাপক মনে করেন, শিশু-কিশোরদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কারো কারো আত্মহত্যা প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নিচের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাবা-মা, ভাই-বোন বা পরিবারের সদস্যদের উচিত, কাউকে অবহেলা না করা। পারিবারিক সহিংসতা বা ঝগড়া-বিবাদ ছোটদের সামনে না করা। সন্তানদের কথা শুনতে হবে, তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। পড়াশোনার জন্য বাড়তি চাপ বা অন্য কারো সঙ্গে তুলনা না করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীরা যেন বন্ধু বা ছোট কাউকে তার শরীর, ত্রুটি নিয়ে কটূক্তি বা তামাশা না করে, এটা বুঝাতে হবে।

শিক্ষকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। পরীক্ষায় খারাপ করলে বকা না দেওয়া। অপমানজনক কথা না বলা। এই বিষয়গুলো সামাজিকভাবে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো। দেশের শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকার কী উদ্যোগ নেবে? নাকি সেমিনার আর র‍্যালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here