অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার প্রস্তাব চট্টগ্রাম মেডিকেলে

0
485
অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার প্রস্তাব চট্টগ্রাম মেডিকেলে

খবর৭১ঃ চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভবন নির্মাণের আগেই যন্ত্রপাতি কেনার ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। এই ডিপিপিতে একই ধরনের যন্ত্রপাতির দামের ব্যবধান প্রায় ৫০০ গুণ। প্রতিটি স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের দাম এক জায়গায় দেখানো হয়েছে দেড় লাখ টাকা, আরেক জায়গায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) নিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সভায় এসব অসংগতি উঠে আসে। হ্যান্ড গ্লাভস, গাউন, বালিশ, কভার, মাস্ক ইত্যাদির দাম কয়েক গুণ বেশি দেখানোর পাশাপাশি একই জিনিসের দামের ব্যবধানও রয়েছে। এ ছাড়া অনেক যন্ত্রপাতির দাম বাজারমূল্য থেকে চার–পাঁচগুণ কম ধরা হয়েছে। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

কমিশনের সভায় সভাপতিত্ব করেন আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ। সভায় পূর্ত বিভাগের কাজ অন্ততপক্ষে ৯০ ভাগ শেষ হওয়ার পর যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া এ ধরনের ডিপিপি তৈরির সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, তা মন্ত্রণালয়কে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি ভবনে অস্থায়ীভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সিলেট ও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদনের বিষয়েও আলোচনা হবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিপিপি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. ইসমাইল খান বলেন, ‘এক মাস আগেই পরিকল্পনা কমিশনের সভায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাই এবং পূর্ত বিভাগের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। দামের অনেক অসংগতি রয়েছে। একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই ডিপিপি করানো হয়। চার শ পৃষ্ঠার এই ডিপিপিতে প্রায় পাঁচ হাজার যন্ত্রপাতি কেনার কথা রয়েছে। আমার সবটা দেখা সম্ভব হয়নি। এ জন্য আমি সভায় দুঃখ প্রকাশ করেছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘আমি একাডেমিক মানুষ। এত হিসাব–নিকাশ বুঝিনি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই কাজ করেছে। তিন–চার বছরের মধ্যে ভবন নির্মাণের পর যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত হয়।’ জানা গেছে, ফিউচার আইটি অ্যান্ড গ্লোবাল সার্ভিসেস নামে ঢাকার মহাখালীর একটি প্রতিষ্ঠান এই ডিপিপি তৈরির কাজ পায়। ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় দরপত্রের মাধ্যমে কাজ নেয় তারা। জুলাই মাসে এই ডিপিপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখান থেকে যাচাই–বাছাইয়ের পর পরিকল্পনা কমিশনে আসে। ফিউচার আইটি অ্যান্ড গ্লোবাল সার্ভিসেসের প্রকৌশলী আবু জাফর মো. ফারুককে ফোন করা হলে তিনি প্রথম আলো বলার পর ফোন কেটে দেন। এরপর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

একই যন্ত্রের দামে ৫০০ গুণ ব্যবধান

ডিপিপিতে পৃথক বিভাগের জন্য কেনার প্রস্তাব করা একই যন্ত্রপাতির দামের পার্থক্য রয়েছে। প্যাথলজি বিভাগের জন্য চারটি স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের দাম প্রতিটি দেড় লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। ল্যাব মেডিসিন বিভাগের জন্য একই মাইক্রোস্কোপের প্রতিটি সাড়ে ৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত দাম ধরা হয়েছে। এতে ব্যবধান দাঁড়ায় ৫০০ গুণ। আবার পৃষ্ঠা ১১৫–তে একই মাইক্রোস্কোপের দাম দেখানো হয়েছে ৫ কোটি টাকা। বৈঠকে বলা হয়, হুবহু একই ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জামাদির দামে বড় ধরনের অসংগতি রয়েছে। আসবাবের ব্যয় প্রাক্কলনেও অসামঞ্জস্য ও অসংগতি রয়েছে। একই ফার্নিচারের প্রাক্কলিত মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম রয়েছে।

৩০ গুণ বেশি বালিশ কভারের দাম

সভায় ১২টি আইটেমেই প্রস্তাবিত মূল্যের সঙ্গে আনুমানিক বাজারমূল্যের পার্থক্য ব্যাপক বলে উল্লেখ করা হয়। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, বালিশের দাম দেখানো হয় ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। কভারের দাম ২৮ হাজার টাকা। বাজারমূল্য থেকে প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধরা হয় প্রাক্কলিত দাম। সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটি ৮৪ হাজার টাকা দেখানো হয়। গাউন দেখানো হয় প্রতিটি ৪৯ হাজার টাকা। এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাক্কলন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে সভায় মত প্রকাশ করা হয়।

১৬ হাজার টাকায় টন এসি

প্রকল্পে কিছু কিছু যন্ত্রপাতির প্রাক্কলিত মূল্য অস্বাভাবিক রকম কম ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ প্রায় ১ হাজার ৫০টি দুই টন এসির প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৬৭৩ টাকা। এ রকম একটি এসির বাজারমূল্য আনুমানিক ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে।

পূর্ত কাজের ব্যয় প্রাক্কলনে অসামঞ্জস্য

প্রস্তাবিত ভবনটি ২০ তলার হলেও ডিপিপিতে ১০ তলা ফাউন্ডেশন ধরে প্রাক্কলন করা হয়েছে। সভায় বলা হয়, নির্মাণ ও পূর্ত খাতে প্রায় ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর যৌক্তিকতা নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সভায় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম গণপূর্ত সার্কেল–৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মইনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রপাতির বিষয়ে ডিপিপি করার ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতা থেকে এই অসংগতি হতে পারে।

বইপত্রের মূল্যে অসামঞ্জস্য

বইপত্র কেনার জন্য মোট ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। বইয়ের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে বইয়ের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে। ক্লিনিক্যাল হেমাটোলজি বইটির দাম ২০১৫ সালের ১৩ নম্বর সংস্করণের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে, যার তিন কপির মূল্য ধরা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটির দাম ৩৪ হাজার টাকা। সভায় বলা হয়, আলোচ্য প্রকল্পটি গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলে ডিপিপিতে এত বেশি অসামঞ্জস্য ও অসংগতি থাকত না বলে সভাপতি মত প্রকাশ করেন।

সভার সিদ্ধান্ত

প্রস্তাবিত প্রকল্পে প্রথমত নির্মাণ ও পূর্ত কাজের দরপত্র আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব খাতে জনবল সৃষ্টি ও নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ২ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ অন্ততপক্ষে ৯০ ভাগ শেষ হওয়া এবং জনবল সৃষ্টির অনুমোদন প্রাপ্তির পর যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়কে যথাযথভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে নির্ভুল ডিপিপি পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ডিপিপি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কারা করা জড়িত ছিল, তা মন্ত্রণালয়কে অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here