খবর৭১ঃ
উৎক্ষেপণের এক বছর চার মাস পর আয়ের খাতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–১। এতে করে দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খরচ কমবে। আজ ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার শুরু হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে দর্শকদের জন্য এই তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো।
তার আগে কিছু সমস্যা থাকার কথা বলা হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পক্ষ থেকে। যদিও বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল) বলছে, পর্যায়ক্রমে এগুলো দূর হয়ে যাবে।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সামনে বড় সমস্যা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দেখা যাবে না। এ জন্য কোনো কোনো চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে গেলেও পাশাপাশি আগের স্যাটেলাইটে যুক্ত থাকছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যোগাযোগ ভূগর্ভস্থ তারের মাধ্যমে হওয়ায় টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারে কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৩৪। এসব টিভি চ্যানেল এখন হংকংভিত্তিক অ্যাপস্টার সেভেন ও এশিয়াস্যাট স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএস-১ ব্যবহার করতে টিভি চ্যানেলগুলোকে দুটি মডুলেটর যন্ত্র কিনতে হচ্ছে। একটি গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন ও আরেকটি বেতবুনিয়া স্টেশনের জন্য। এই বাড়তি খরচ যাতে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর বোঝা না হয়, সে জন্য বিসিএসসিএল তাদের স্যাটেলাইটের তরঙ্গ বরাদ্দ (ফ্রিকোয়েন্সি) ভাড়া কমিয়েছে। বর্তমানে টিভি চ্যানেলগুলো চলে ৫ থেকে ৬ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে। প্রতি মেগাহার্টজের জন্য মাসে ভাড়া দিতে হয় ৪ হাজার ডলার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে সেটি ৪ হাজার ডলার থেকে কমিয়ে ২ হাজার ৮১৭ ডলার নির্ধারিত হয়েছে। দ্বিতীয় বছরে গিয়ে ৩ হাজার ৫০০ ডলার ভাড়া নির্ধারণ করেছে বিসিএসসিএল। বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করে টিভি চ্যানেলগুলোকে মাসে ১৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হতো। আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হবে ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকা।
পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে থাকা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আমাদের টিভির সিগন্যাল ট্রান্সমিশন করছি। পাশাপাশি বিদেশি স্যাটেলাইটও চলছে। তবে বিদেশি স্যাটেলাইটের সিগন্যাল বন্ধ করে দিলে মাঝেমধ্যে ঝামেলা হয়। বিষয়টি আমরা বিসিএসসিএল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
দেশের প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইট ‘অন্বেষা’ ২০১৭ সালের ২ জুন মহাকাশে যায়। অন্বেষা প্রকল্পের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এক অংশ তারযুক্ত এবং আরেক অংশ তারহীনভাবে পরীক্ষামূলক চলছে। ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত এ দূরত্বে অপটিক্যাল ফাইবার হচ্ছে। তবে ঢাকার রাস্তায় সংস্কারকাজসহ বিভিন্ন কারণে এ পদ্ধতিতে যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ঢাকায় একটি গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করলে সুবিধাজনক হতো বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
অবশ্য এ সমস্যা সমাধানে বিসিএসসিএল মাটির ওপরে ও নিচে দুভাবে অপটিক্যাল ফাইবার লাইন টেনে গাজীপুরে সজীব ওয়াজেদ জয় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে সিগন্যাল নিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হতে বাংলাদেশের ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা খরচ হয়। দেশের প্রথম উপগ্রহ বিএস-১ উৎক্ষেপণ হয় ২০১৮ সালের ১১ মে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে।
বিসিএসসিএলের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারিগরি জটিলতাগুলো সংশোধন ও সমন্বয়ের কাজ প্রতিনিয়ত চলছে। পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের শুরু থেকে এসব ঠিক করা হচ্ছে। বাকি কাজগুলোও ঠিক হয়ে যাবে। নভেম্বর থেকে স্যাটেলাইট ভাড়ার বিল করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশের সব এলাকা ভালোভাবে কভার করবে। কিন্তু অরবিট সুবিধামতো জায়গায় না পাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে এর মাধ্যমে চ্যানেলগুলো দেখা যাবে না। এ প্রসঙ্গে তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, চাইলেই অরবিট পাওয়া যায় না। এটা খালি থাকতে হয়। আবার এটা পেতে অন্যরা অপেক্ষায় থাকে। একটি আন্তর্জাতিক কমিটি এটি নির্ধারণ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি চ্যানেলের ব্রডকাস্ট বিভাগের প্রধান বলেন, বিদ্যমান স্যাটেলাইট থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে যেতে চাইলে আপলিংকের কিছু যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করতে হবে। এটা করতে পারলে পুরোটাই তারবিহীন হবে। চ্যানেল মালিকেরা পর্যায়ক্রমে আপলিংকের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করবেন।
পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের পুরোটা সময় বিএস–১–এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ডিবিসি চ্যানেল। চ্যানেলের সম্প্রচার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্রডকাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হামিদ উল্লাহ বলেন, টিভি চ্যানেলের সঙ্গে গ্রাউন্ড স্টেশনের অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে। অ্যানটেনার চেয়ে তারযুক্ত যোগাযোগে অপেক্ষাকৃত ঝুঁকি আছে। ঢাকার রাস্তায় যে পরিমাণ সংস্কারকাজ হয়, তাতে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যায়। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যদি নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করে, তাহলে টিভি চ্যানেলগুলো কোনো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।