খবর৭১ঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও মানবতার ক্ষেত্রে সন্ত্রাস এবং উগ্র চরমপন্থাকে দু’টি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দুই ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য চার দফা প্রস্তাব উত্থাপণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করছে। আমরা বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই। কোন সীমানা নেই।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজ্জিত করেছি। সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপও গ্রহণ করেছি।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময়ে বুধবার বিকালে কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস-সিএফআর আয়োজিত ‘এ কনভারসেশন উইথ অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা’ শীর্ষক অংশগ্রহণমূলক সংলাপে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী মো. আবুল কালাম আজাদ, সিএফআর সভাপতি রিচার্ড এন. হাসসহ সংস্থাটির সদস্যরা।
ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও উগ্র চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য চার দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, এক. সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের যোগান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। দুই. তাদের অর্থের যোগান বন্ধ করতে হবে। তিন, সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। চার. আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মধ্যদিয়ে উভয় পক্ষের জন্য সমান সুবিধাজনক পরিস্থিতি নিশ্চিতের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা এই সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ ও তাৎক্ষণিক সমাধান চাই। মিয়ানমারই এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারেই রয়েছে। মিয়ানমার সরকার একটি পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে উত্তর রাখাইন রাজ্য থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নিধন শুরু করে। রোহিঙ্গারা নৃশংসতা ও সন্ত্রাস থেকে পালিয়েছিল। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত খুলে দেই। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সাধ্যমত সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, এবং যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে বাংলাদেশের কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এ সমস্ত শিবির পরিদর্শনে এসে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা রোহিঙ্গাদের নিধনযজ্ঞের বিভিন্ন নৃশংস ঘটনাবলী শুনলে আপনারা কেঁপে হয়ে উঠবেন। আপনাদের হৃদয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হবে এবং আপনারা শিগগিরই রোহিঙ্গাদের এসব বেদনাদায়ক পরিস্থিতির অবসান চাইবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে আরেকটি যে বিষয় কাজ করেছে তা হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালিন বাংলাদেশীদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বিষয়টি। সে সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি জনগণ প্রতিবেশী দেশ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ নৃশংসভাবে হত্যার পর আমি নিজেও শরণার্থী হয়ে পড়েছিলাম। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেবলমাত্র আমি এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। প্রায় ছয়টি বছর তৎকালিন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান আমাদেরকে দেশে ফিরতে দেয়নি। যে কারণে, ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হই।
ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা এবং বিদ্বেষ প্রসূত বক্তব্যের বিস্তার রোধে ডিজিটাল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক উভয় অংশীদারদের সঙ্গেই চমৎকার সহযোগিতা বিদ্যমান রয়েছে। যে কারণে, ২০০৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদশের হলি আর্টিজান বেকারীতে সন্ত্রাসি হামলার পর এই পর্যন্ত আর কোন বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারেনি। আমাদের জনগণ এখন সতর্ক রয়েছে কেননা আমরা তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সহযোগিতার জন্য আমরা আমাদের সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গেছি।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্যই বিশ্বব্যাপী বছরজুড়ে ঘুর্ণিঝড়, বন্যা এবং ক্ষরার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় তার সরকার ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এন্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯ প্রণয়ন করেছে উলেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘এই অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় নিজস্ব সম্পদের দ্বারা বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের পরে প্রায় কয়েকশ’ প্রকল্পে যার বেশিরভাগই অভিযোজন এবং অভিবাসন সংক্রান্ত তাতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নকে তার সরকারের একটি অন্যতম নীতি আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নারী এবং পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাটা জরুরি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দেশে নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে সকল শ্রেণী পেশার ক্ষেত্রে সরকার নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে বলেন, প্রশাসন, রাজনীতি, স্থানীয় সরকার, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশের নারীরা সাফল্যের সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, কাঙ্ক্ষিত জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সরকার মনে করে যে, এ জন্য নারীর ক্ষমতায়ন তার সরকারের নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশে রাজনীতি, সরকার, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সংস্থা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থা এবং এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে নারীরা উচ্চপদে আসীন।
প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ভিত্তিক ডিজিটাল সার্ভিস চালু, বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদানের পাশাপাশি আর্থসামাজিক খাতগুলোতে তার সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ তার আর্থসামাজিক উন্নয়নে গর্বিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যথাসময়েই এমডিজি অর্জন করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-২০৩০ অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সর্বত্র উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বাস্তবমুখী জননীতির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আমাদের নতুন স্লোগান হচ্ছে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’। এই কৌশল ও প্রচেষ্টা ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের মানদণ্ড অর্জন নিশ্চিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইএমএফ রিপোর্ট-২০১৯-এ বাংলাদেশ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি এবং পিপিপি হিসেবে বিশ্বের ৩০তম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলা হয়েছে যে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ হচ্ছে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ।
পরে, প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, তৈরি পোশাক খাতের অবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই আলোচনা প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে বলে দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার ১৯৮২ সালে তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে। সংবিধানে তারা রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিক হিসেবে না বলে বহিরাগত বলে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সংলাপ শুরু করে। এক পর্যায়ে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের সকল সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য কাজ করছে। মিয়ানমারের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে গিয়ে তাদের নিজ ভূমিতে বসবাস করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার একটি দ্বীপের উন্নয়ন করে সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে ঘরবাড়ি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও খাদ্য মজুত রাখার গুদামঘর নির্মাণ করেছে। তিনি বলেন, যদি আমরা ভাসান চর নামের ওই দ্বীপে তাদেরকে স্থানান্তর করতে পারি, তাহলে কিছু লোক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে এবং তাদের শিশুরা শিক্ষার সুবিধা পাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে আমার ধারণা হয়েছে যে, কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন চায় না এসব লোক তাদের দেশে ফিরে যাক। তারা (সংগঠনগুলো) রোহিঙ্গাদের আটকানোর চেষ্টা করছে।
মুসলিম উম্মাহ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যখন কোন সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সংলাপ অথবা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। আপনারা জানেন কোথায় সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সম্পদশালী দেশ রয়েছে তারা তাদের সম্পদ নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে পারছে না এবং তাদের যারা সহযোগিতা করছে তাদেরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা বিভক্তি ও শাসন করার নীতি গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি এবং মুসলিম জনগণকে তা অনুধাবন করতে হবে