খবর৭১ঃ ছাত্রদলের কাউন্সিল প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ভুল করেছে বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রদল হচ্ছে সহযোগী সংগঠন। সংগঠনটি নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে। লিখিতভাবে বিএনপির কোনো নেতা ছাত্রদলের কর্মকাণ্ডে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
কিন্তু কাউন্সিল প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তা অনুসরণ করেননি বিএনপি নেতারা। কমিটি বিলুপ্ত এবং ১২ নেতাকে বহিষ্কারে সরাসরি দলটির সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপ ছিল।
যা আইনত গঠনতন্ত্রবিরোধী। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে সুযোগসন্ধানীরা। যেখানে সরকারের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
এদিকে আদালতের আদেশ নিয়ে বিএনপি নেতা ও তাদের আইনজীবীদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। দলের মহাসচিবসহ নেতাদের অভিযোগ- সরকারের নির্দেশেই ছাত্রদলের কাউন্সিলের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আদালত।
কিন্তু আদেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে আইনজীবীরা দেখেছেন- ওই আদেশে কাউন্সিল স্থগিতের কোনো নির্দেশনা নেই। কাউন্সিলের ব্যাপারে শুধু বিএনপির ১০ নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। তাই কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট যাদের শোকজ করা হয়েছে তাদের এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে যথাসময়ে কাউন্সিল করা যেত।
তাদের মতে, গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজের তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই আদালত ছাত্রদলের কাউন্সিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাশাপাশি শোকজ করেন বিএনপি নেতাদের। ফলে শেষ মুহূর্তে আটকে যায় কাউন্সিল। এরপরই নেতাদের টনক নড়ে। আলোচনায় আসে সরাসরি হস্তক্ষেপের বিষয়টি।
এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত ছিল বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, অতীতের ধারবাহিকতায় এসব করা হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে কেউ আদালতে যাবেন তা তাদের ধারণায় ছিল না।
এদিকে ছাত্রদলের কাউন্সিলের ওপর আদালতের দেয়া শোকজের জবাব তৈরি করছে দলটি। বিষয়টি নিয়ে দলের আইনজীবীরা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে আইনি কোনো ফাঁকফোকর না থাকে।
পাশাপাশি নিম্ন আদালতের দেয়া স্থগিতাদেশ স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই ছাত্রদলের কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কাউন্সিলের অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নতুন করে গঠন করা হতে পারে সম্মেলন প্রস্ততি কমিটিও।
এদিকে ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে শনিবার সকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় করেন। পরে সামনের সড়কে কয়েকশ’ কর্মী-সমর্থক জড়ো হয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন।
জানতে চাইলে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ও কাউন্সিল পরিচালনায় গঠিত আপিল কমিটির সদস্য ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ছাত্রদলের কাউন্সিল প্রক্রিয়ার শুরুতে কিছুটা ভুল হয়েছে তাতে দ্বিমত নেই।
কিন্তু একটি দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তার নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। সরকার নীল নকশার অংশ হিসেবে আদালত দিয়ে ছাত্রদলের কাউন্সিলে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। যাতে বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে না পারে।
তিনি বলেন, সরকারের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পর আমরাও এখন থেকে সতর্ক থাকব। ভবিষ্যতে আইনি কোনো ফাঁকফোকরে যাতে পুনর্গঠন আটকাতে না পারে সেদিকটি খেয়াল রাখা হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ছাত্রদলের কাউন্সিল পরিচালনায় গঠিত আপিল কমিটির প্রধান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা আদালতে যাব, এটা সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্থগিতাদেশের বিষয়টি ফয়সালা হলে কাউন্সিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি আরও বলেন, কিভাবে কাউন্সিল সফল করা যায় তা সবার মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রদল বিএনপির সহযোগী সংগঠন। সেই হিসেবে তারা নিজ নিজ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে। কিন্তু ছাত্রদলের এখনও লিখিত কোনো গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়নি।
অতীতের ধারাবাহিকতায় বিএনপির হাইকমান্ডই সরাসরি সংগঠনটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। কিন্তু ছাত্রদলের কাউন্সিলের পূর্বে সাবেক কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ অনেকেই এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার পক্ষে মত দেন।
তারা জানান, ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত ও কাউন্সিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপিকে জড়ানো ঠিক হবে না। হাইকমান্ডের নির্দেশে সবকিছু হলেও লিখিতভাবে যেন দলের কোনো নেতার হস্তক্ষেপের বিষয়টি না থাকে।
এতে ভবিষ্যতে কেউ আইনের আশ্রয় নিলে কাউন্সিল আটকে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সভা ডেকে সবার মতামত নিয়ে কমিটি বিলুপ্ত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করার পরামর্শও দেন তারা।
কিন্ত বিএনপির হাইকমান্ড তাদের পরামর্শকে গুরুত্বই দেয়নি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর কাউন্সিলের লক্ষ্যে তিনটি কমিটিও গঠন করা হয়।
হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ছাত্রদলের একাংশ বিক্ষোভ করে। তারা দলীয় কার্যালয়ে ভাংচুর চালায়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ছাত্রদলের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। ওই বহিষ্কারাদেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষর করেন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারা তা পারেন না। এ দুটি বিষয়কে সামনে এনেই আমান উল্লাহ আমান নামে ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা আদালতে আবেদন করেন। তার আবেদনের ওপর ভিত্তি করে আদালত বিএনপি নেতাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।
আদালতের আদেশ পাওয়ার পরই পরবর্তী করণীয় নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে আইনজীবীদের মতামতও নেয়া হয়। শুক্রবার রাতে সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা।
ওই বৈঠকে শোকজের জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে একাধিক আইনজীবী বলেন, শোকজ নিয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না। আদেশটি গুরুত্ব সহকারে পড়ে একটি নির্ভুল জবাব তৈরি করতে হবে। যাতে আইনি কোনো ফাঁকফোকর না থাকে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আইনজীবীরা শোকজের প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরেন। এক আইনজীবী বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রদলের কাউন্সিলের ব্যাপারে বিএনপি নেতারা কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। কিন্তু সংগঠনটির কমিটি বিলুপ্ত ও ১২ নেতার বহিষ্কারে বিএনপি নেতাদের স্বাক্ষর রয়েছে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তা সঠিক হয়নি। আদালত এ বিষয়টি সামনে এনেছেন। ওই আইনজীবীর এমন বক্তব্যের পর বিএনপি নেতারা জানতে চান আইনিভাবে এটা কিভাবে মোকাবেলা সম্ভব।
সূত্র জানায়, বৈঠকের পর শোকজের জবাব দিতে কাজ করছেন আইনজীবীরা। আদালতের আদেশের জবাবে তারা বলবেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রদলের সাংগঠনিক প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তাছাড়া তার বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশে আদালতের একটি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে বিএনপি নেতাদের স্বাক্ষরে এসব করা হয়েছে।
যদিও তা আইনসম্মত হয়নি। ভবিষ্যতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে বলেও শোকজের জবাবে জানানো হবে।
বৈঠকে আইনজীবীরা কাউন্সিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিএনপির হস্তক্ষেপ দূর করতে কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে- কাউন্সিলরদের সভা ডেকে বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন অথবা কাউন্সিলরদের কয়েকজনকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা।
তবে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তা হল- ইউনিট কমিটির কাউন্সিলর (ভোটার) কাউকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া। প্রয়োজনে কয়েকজন কাউন্সিলরকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
জেলা, মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের শীর্ষ নেতা অথবা কাউন্সিলরদের বৈঠক আহ্বান করে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন নেতারা।
একটি সূত্র জানায়, মামলার বাদী ছাত্রদল নেতা আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকা নেতাদের মতামত হচ্ছে, যেহেতু আমান ব্যক্তি উদ্যোগে মামলা করেছেন, সেহেতু এই মামলা তিনি প্রত্যাহার করে নিলে সমস্যার সমাধান সহজ হবে।
উচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও কেউ কেউ এ ব্যাপারে ভেবে দেখার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখলে ছাত্রদলের পুরো কার্যক্রম থমকে যাবে।
জানতে চাইলে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, কোনো দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিএনপি মহাসচিব কে- এ ইস্যুতে উচ্চ আদালতে একটি শুনানি হয়। সেখানে উচ্চ আদালত স্পষ্ট জানান, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ব্যাপার।
কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা থাকার পরও ছাত্রদলের কাউন্সিল নিয়ে নিম্ন আদালতের আদেশ দুঃখজনক।
তিনি বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে এমন একটি অবৈধ আদেশ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারপরও আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালতের শোকজের জবাব দেয়া হবে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি।
যথাসময়ে যথাযথ নিয়মে আমরা এর জবাব দেব। এ আইনজীবী আরও বলেন, ছাত্রদল নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আদালত বিএনপি নেতাদের শোকজ করেছেন। ছাত্রদলের কাউন্সিলের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি। এমনকি ছাত্রদলের কোনো নেতাকে শোকজও করেননি। তাই ছাত্রদলের কাউন্সিলে আইনগত কোনো বাধা আছে বলে আমি মনে করি না।