খবর৭১ঃ খোদ রাজধানীতেই গত পাঁচ মাসে পুলিশের ওপর বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো হামলা হয়েছে। এমনকি বোমা পেতেও রাখা হয়েছে। এসব ঘটনায় কেউ মারা না গেলেও বেশ কয়েকজন পুলিশ ও আনসার সদস্য আহত হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনার পরই আইএসের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হয়েছে। সাইট ইন্টেলিজেন্সের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, পুলিশকে টার্গেট করেই জঙ্গিরা এসব হাতবোমা হামলা করেছে।
এই ঘটনাগুলোর পর সাধারণভাবেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন তাদের টার্গেট? আবার যে হামলাগুলো হয়েছে, সেগুলো যদি হাতবোমা না হয়ে শক্তিশালী কোনো বোমা হতো তাহলে বহু মানুষ, বিশেষ করে অনেক পুলিশ সদস্য মারাও যেতে পারতেন? তাহলে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাখার যে কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? পুলিশ বা গোয়েন্দারা তাহলে করছে কী?
সর্বশেষ শনিবার রাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের গাড়ির অদূরে হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে মন্ত্রীর প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা এএসআই শাহাবুদ্দিন (৩৫) ও কনস্টেবল আমিনুল (৪০) আহত হন। এই হামলার ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে থানার এসআই জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন। ধানমন্ডি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আতিকুল ইসলাম বলেন, বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। মামলার সব আসামি অজ্ঞাত।
মন্ত্রীর যাত্রাপথে এ হামলার ঘটনার পর শক্তভাবেই তদন্ত করতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্ত কমিটির পাশাপাশি একটি উচ্চতর তদন্ত সহায়তা কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামকে প্রধান ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলমকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি তাদের সহযোগিতা করবে।
কেন বারবার এই হামলা জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে গুলিস্তান, মালিবাগ বা পল্টন-খামারবাড়ীর ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত করা গেলে আর হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না। ওই সব ঘটনার অগ্রগতি থাকলেও এখনো কিনারা হয়নি। আমরা গুরুত্ব সহকারেই দেখছি।’
এই ঘটনাগুলোর পর গোয়েন্দারাও বসে নেই। দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তদন্তে যা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, একটি জেলার শিবিরের সাবেক সভাপতি বর্তমানে ইরাকে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। দেশে তার সহযোগীরা আছে। কিছু ঘটে গেলেই সহযোগীরা তাকে জানিয়ে দেয়। ওই শিবির নেতার মাধ্যমেই আইএসের অনুমোদন নিয়ে দায় স্বীকার করা হচ্ছে। এরপর সাইট ইন্টেলিজেন্স থেকে প্রচার হচ্ছে।
একের পর এক হামলার ঘটনায় পুলিশকে আরো শক্তিশালী করার দাবিও উঠেছে। উন্নত দেশগুলোর মতো পুলিশের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি উন্নত করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টা রাজপথে থাকে পুলিশ। ফলে সহজেই তারা আক্রমণের শিকার হন। এই সরকারের আমলে পুলিশের জনবল, সরঞ্জাম সবই বাড়ানো হয়েছে। এখন আরো প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
কেন পুলিশকেই বারবার টার্গেট করা হচ্ছে? জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, হামলায় ব্যবহূত বস্তুগুলো ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ছিল। পুলিশকে টার্গেট করেই এই হামলা ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪-১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাসীরা দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এরপর বিদেশি নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। এরপর পুলিশ দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই কারণে পুলিশের ওপর তাদের ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। তাই পুলিশের মনোবল ভেঙে দিতে তাদের এই চেষ্টা।’
উল্লেখ্য, গত ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে একটি ট্রাফিক বক্সের পাশে হাতে তৈরি বোমা বা আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য ও একজন কমিউনিটি পুলিশ আহত হন। এ ঘটনার ঠিক ২৮ দিন পর গত ২৬ মে রাত পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর মালিবাগের পলওয়েল ফিলিং স্টেশনের বিপরীতে ফ্লাইওভারের নিচে রাখা পুলিশের বিশেষ শাখার একটি পিকআপভ্যানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতেও ট্রাফিক পুলিশের এএসআই রাশেদা আক্তার, লাল মিয়া নামে একজন রিকশাচালক ও শাহনাজ শারমিন নামে এক পথচারী আহত হন। এছাড়া ২৩ জুলাই রাতে রাজধানীর পল্টন ও খামাড়বাড়ী পুলিশ বক্সের কাছে ফেলে রাখা বোমা উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এখন তো আর জঙ্গিরা দাঁড়াতেই পারছে না। কিছু করলেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। এখন তো তাদের বড় ধরনের কোনো হামলা করার সক্ষমতা নেই। তাই কিছু কাজ করে জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে ওদের নেটওয়ার্ক পুরো ভেঙে গেছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই টার্গেট করছে। আর যত কথাই বলা হোক, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই, সব স্থানীয় জঙ্গি।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমরা জঙ্গিদের মনোবল ভেঙে দিতে পেরেছি। কিছু হলেই তারা ধরা পড়ে, তাই পুলিশকে শত্রু মনে করছে। ওরা আমাদের টার্গেট করবে, এটাই তো স্বাভাবিক? যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তারও তদন্ত হচ্ছে। অপরাধী ধরা পড়বেই।’
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যারা রাজপথে পারেনি, তারা এখন পুলিশকে টার্গেট করছে। ২০১৪-২০১৫ সালে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের কারণে তাদের সে চেষ্টা নসাত্ হয়েছে। এখন তারা পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তাদের এই চেষ্টাও সফল হবে না, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আর দেশে কোনো আইএস নেই। কঠোরভাবে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করেছি, তবে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারিনি। তাই মাঝে মধ্যে তারা জানান দেয়। এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে, এরা ধরা পড়ে যাবে।’