খবর৭১ঃ
বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার একটি। ঐ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাবও ফেলেছে। ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন দলটির সিনিয়র নেতারা। দলটির প্রধান এবং তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ছিলেন ঐ সমাবেশের প্রধান অতিথি।
আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে রাস্তায় একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বিকেল তিনটা থেকে দলটির কিছু মধ্যম সারির নেতা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। বিকেল চারটার দিকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য দেয়ার পালা। ঐ সমাবেশে তখন উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের তৎকালীন সদস্য আমির হেসেন আমু।আমির হোসেন আমু বলেন, “নেত্রীর বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনলাম। প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, এদিক-ওদিক তাকালাম। তখন চারপাশে চিৎকার শুনতে পেলাম।”
এভাবে দফায়-দফায় বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠে। সমাবেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এটি ছিল গ্রেনেড হামলা। অনেকেই ভেবেছিলেন বোমা হামলা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করেছিলেন।
যখন গ্রেনেড হামলা শুরু হলো, তখন মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা শেখ হাসিনার চারপাশে ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেন – যাতে তাঁর গায়ে কোন আঘাত না লাগে। যেসব নেতা শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। তখন হানিফের মাথায় গ্রেনেডের আঘাত লেগেছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের শেষের দিকে তিনি মারা যান।
গ্রেনেড হামলার পর তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নেতা-কর্মীরা জীবন দিয়ে তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার নেতা-কর্মীরা সবাই আমাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে অনেকেই ইনজিউরড (আহত) হয়েছে। তাদের রক্ত এখনও আমার কাপড়ে লেগে আছে। আমার নেতা-কর্মীরা তাদের জীবন দিয়েই আমাকে বাঁচিয়েছে।”
ঐ গ্রেনেড হামলায় ২৪জন নিহত, আর আহত হয় আরও অনেকে। গ্রেনেড হামলায় আহত অনেকেই এখনও শরীরে আঘাত নিয়ে বেঁচে আছেন। এদের একজন নাসিমা ফেরেদৗসি। তাঁর শরীরে এখনও দেড় হাজারের মতো গ্রেনেডের স্প্লিনটার রয়েছে। শরীরের ভেতর এসব স্প্লিনটার নিয়ে যন্ত্রণা-কাতর জীবন পার করছেন নাসিমা ফেরদৌসি।
ঘটনার দিন মঞ্চের খুব কাছেই অবস্থান করছিলেন নাসিমা ফেরদৌসি। ২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে নাসিমা ফেরদৌসি বলেন, “হঠাৎ করে এক বিকট আওয়াজ শুনলাম। এরপর আরেকটি আওয়াজ। আমি দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমরা পা নড়ছিল না।”
“দ্বিতীয় আওয়াজের সাথে সাথে দেখলাম আমার শরীর রক্তে ভেসে গেছে। এরপর আমি সেন্সলেস (অজ্ঞান) হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখলাম লাশ আর লাশ। আমি বলছিলাম বাঁচাও-বাঁচাও।”
কিছুক্ষণ পরে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নাসিমা ফেরদৌসি। আশপাশের সবাই ভেবেছিল নাসিমা ফেরদৌসি মারা গেছে। তাকে মৃত ভেবে একটি মৃতদেহবাহী ট্রাকে তোলা হয়। তখন আবারও জ্ঞান ফিরে আসে নাসিমা ফেরদৌসির। ব্যথায় চিৎকার করে তিনি আবারও বলতে থাকেন ‘বাঁচাও-বাঁচাও’।
গ্রেনেড হামলায় নাসিমা ফেরদৌসির দুটো পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তার পা দু’টো কোন রকমে টিকে যায়। কিন্তু চার বছর তাকে কাটাতে হয়েছে হুইল চেয়ারে।
২১শে অগাস্টের হামলার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে পুলিশ উল্টো তাদের হেনস্থা করেছে। সে সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকারের ভূমিকা নিয়েও নানা বিতর্ক এবং প্রশ্ন রয়েছ।
ঘটনার পর দেয়া সাক্ষাৎকারে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের নেতা-কর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করতে গেছে, ঠিক সে সময় পুলিশ উল্টো টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ ও তাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে পুলিশ যখন উল্টো টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার করতে শুরু করলো, তখন বুঝতে পারা যায় যে এ ঘটনা তাদের মদদে হয়েছে। এই মামলার বিচার কাজ এখনও নিম্ন আদালতে চলছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গ্রেনেড হামলার সেই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, তাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার জন্যই সেদিনের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এই ধারণার সাথে অনেকেই একমত পোষণ করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তিক্ত, যার একটি বড় কারণ হচ্ছে ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা। গ্রেনেড হামলার ঘটনা দুই দলকে আরও বেশি বিপরীত মেরুতে ঠেলে দিয়েছে। গ্রেনেড হামলার সময় এবং তারপরের তদন্ত নিয়ে পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় প্রশ্ন উঠেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে।
জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় পুনরায় তদন্ত হয়।
সেখানে নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর নাম আসে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পুনরায় তদন্ত হয়।
ঐ তদন্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সহ বেশ কয়েকজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং পুলিশের সাবেক তিনজন মহাপরিদর্শক বা আইজিপি’র নাম আসে। বিএনপি অবশ্য এই তদন্তকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক’ বলে বর্ণনা করে।