খবর৭১ঃ দেশে ডিজিটাল ও অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং এবং কুরিয়ার সার্ভিসের সব ধরনের আর্থিক লেনদেনে নজরদারি করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুদক সেবাদানকারী নন-ব্যাংকিং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যে কোনো ঘটনা অনুসন্ধান করতে পারবে।
দুদক থেকে চলতি সপ্তাহেই দেশের সবকটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিকে চিঠি দেয়া হবে। এতে তাদের গ্রাহকদের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশের বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হবে।
বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, নগদ, এসএ পরিবহন, কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিস, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে এই চিঠি পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। গত ২২ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এক যৌথ সভায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিসের লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে দুদক ও বিএফআইইউ অনুসন্ধান করতে পারবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম। এ বিষয়ে তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি ছুটিতে আছি, এখন কথা বলব না। পরে অফিসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন তিনি।
সূত্র জানায়, ওই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর, বিটিআরসি ও বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, দুদক সচিবসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমডি এবং সিইও’কে দেয়া হয়েছে। কিভাবে মোবাইল ব্যাংকিং একটি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আনা হবে সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের কাছে প্রয়েজনীয় সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের জন্য হিসাব খোলার ক্ষেত্রে মোবাইল সংযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট ও ছবি অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরম পূরণ এবং তাতে বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ নেয়ার বিধান আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। এর আগে দুদকের পক্ষ থেকে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইল ফোনের সিম বিক্রির সময় বিভিন্ন ব্যক্তির আঙুলের ছাপ ও ঠিকানা ব্যবহার, এজেন্টের মাধ্যমে টাকা প্রেরণ ও গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অর্থ প্রেরণকারী ও গ্রহণকারীর তথ্য রাখা হয় না। লেনদেনের বিপরীতে কোনো ইনভয়েস রসিদ দেয়া হয় না। লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রেরক ও প্রাপককেও কোনো ধরনের রসিদ দেয়া হয় না। দুদকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিছু কুরিয়ার সার্ভিস অবৈধভাবে সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের ডাক দ্রব্যাদি আদান-প্রদানের মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা প্রেরণ করার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের (প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী) কারও কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জনগণ উপকৃত হলেও নানা ধরনের অপরাধ, মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতির ঘটনা বাড়ছে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেনের আড়ালে ঘুষ আদান-প্রদান করা সহজ। এছাড়া চাঁদাবাজি, প্রতারণা, মাদক ব্যবসার টাকা লেনদেন ও মানি লন্ডারিংসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এতে অর্থ লেনদেনের ঝুঁকিও বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে দুদক সুপারিশ করেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, অপরাধী ও দুর্বৃত্তরা যেন এসব সার্ভিসের মাধ্যমে অপরাধ করতে না পারে এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত না হয়, তা নিশ্চিত করতেই কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই সভায় লাইসেন্সবিহীন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে ডাকদ্রব্য প্রেরণ বন্ধে সুপারিশ করা হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব রিজওয়ানুল হুদা সভায় বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের আর্থিক লেনদেন করলে তা অবৈধ হবে। তিনি জানান, কুরিয়ার সার্ভিসগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটা বন্ধ করা জরুরি।
দুদকের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আমরা অচিরেই ওইসব প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ডাটাবেজ বা সার্ভারের মাধ্যমে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অবহিত করে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দেব। বলতে পারেন, এখন থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ও কুরিয়ার সার্ভিসের আর্থিক লেনদেন দুদকের নজরদারির আওতায় এলো।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওই সভায় গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিসের লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহক তথ্য (কেওয়াইসি) সংক্রান্ত নিয়মাবলি পালন করতে হবে। লেনদেনের জন্য এজেন্ট কর্তৃক ডিজিটাল রসিদ প্রদান করতে হবে। লেজার বইয়ে লেনদেনের হিসাব ও স্বাক্ষরের বিধান করতে হবে। লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিু সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আরও বলা হয়, কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক লেনদেন করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক অনুমোদিত মাদক ও অস্ত্র শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে তাদের গ্রাহকদের এনআইডির তথ্য ‘ক্রসচেক’ করতে পারে সে বিষয়ে বিটিআরসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ‘নগদ’-এর কার্যক্রম পরিচালনায় যাতে মানি লন্ডারিং বা অবৈধ লেনদেন না হয় সে বিষয়ে ডাক বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা যোগাযোগ রাখবে।