খবর৭১ঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় খুনির মধ্যে দুজনকে ফেরানোর ওপর সরকারের সব মনোযোগ। কারণ, অন্য চারজন কে কোথায় আছেন, তা নিয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের ৯ বছর পর সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী। আর কানাডায় মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলোপ হওয়ায় এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে ফেরানোটা আটকে আছে আইনি প্রক্রিয়ায়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পালিয়ে থাকা ছয় আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনির মধ্যে দুজনকে ফেরানোর ব্যাপারে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে নূর চৌধুরীকে ফেরাতে আইনি লড়াই শুরু হয়েছে কানাডায়। তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর আগে ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা প্রি-রিস্ক রিমুভাল অ্যাসেসমেন্টের (পিআরআরএ) বিষয়ে রায় পেতে গত বছরের জুলাইয়ে কানাডার সরকার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করেছে। এ বছরের মার্চে মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। সেপ্টেম্বরে নূর চৌধুরীর অবস্থানের বিষয়ে রায় বা মতামত দেবেন কানাডার আদালত। এ ছাড়া রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্কাডেন এল এলপি নামে একটি আইনি পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ করেছে সরকার।
কানাডার একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, নূর চৌধুরীর বিষয়ে কানাডার আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর বাংলাদেশ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে। আদালত যদি জানিয়ে দেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টিকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশের কাছে নূরের অবস্থান জানানো হবে না; সে ক্ষেত্রে রায়ের বিষয়ে আপিল করবে বাংলাদেশ সরকার। আর আদালত নূর চৌধুরীর সবশেষ অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানালে তাঁকে ফেরানোর সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত সপ্তাহে আলাদাভাবে এই প্রতিবেদকের কাছে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে খানিকটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আর নূর চৌধুরীর ব্যাপারে গত বছর কানাডায় দায়ের করা মামলাকে অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফেরানোর সবশেষ অবস্থান জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৭ আগস্ট বিকেলে তাঁর দপ্তরে বলেন, ‘খুনিদের ফেরাতে সময় লাগবে। তবে আমরা বসে নেই। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেই কূটনৈতিক এবং আইনি পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আমরা একটা সমাধানে আসতে পারব। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি অঙ্গরাজ্যে এখনো মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। বিশ্বের অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রথা স্থগিত (মোরাটরিয়াম) করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। সে জন্য রাশেদ চৌধুরীর বিষয়টি আমরা তাড়াতাড়ি সমাধান করতে পারব। আমি কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে রাজি নই। এটা তো আলোচনার ওপর নির্ভর করে। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের ফিরিয়ে আনতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।’
রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের কোন অঙ্গরাজ্যে আছেন। তাঁকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদের কারণ জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা জানি তিনি কোথায় আছেন। কৌশলগত কারণে কিছুটা গোপনীয়তা রাখতে হয়। তবে অন্য চারজনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তাঁদের ব্যাপারে যেসব খবরাখবর আসে, সেগুলো কতটা সত্য, তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই।
ঢাকা ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরানোর ব্যাপারে দুই পক্ষের আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি রয়েছে। অতীতে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কথা না বললেও ইদানীং বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা চিঠিতেও রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। এ বছর ওয়াশিংটনে অন্তত তিন দফায় দুই দেশ এ নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেই বাংলাদেশকে জানিয়েছে, এ বিষয়টি জনসমক্ষে আসুক সেটি তারা চায় না। ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন রাশেদ চৌধুরী।
নূর চৌধুরীকে ফেরানোর প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ৮ আগস্ট তাঁর দপ্তরে বলেন, ‘নূর চৌধুরীকে কানাডা এবং রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরানোর বিষয়ে দুই দেশের সরকারের পরামর্শ ও আমাদের বিবেচনা অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আলোচনা চলছে। আমরা আশা করি, তাদের বোঝাতে সক্ষম হব।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘কানাডার আদালতে নূর চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের মামলাটি এখনো ঝুলে আছে। আমরা এটারই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা জানতে চেয়েছি তাঁর অবস্থান এখন কোন পর্যায়ে আছে। ওই মামলার শুনানি হয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে রায় দেওয়া হবে। আমরা এতে আমাদের পক্ষেই মতামত পাওয়ার আশা করছি। এটি হলে আমরা তাঁকে এখানে এনে রায় কার্যকর করার সুযোগ পাব।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে জানান, কয়েক বছর আগে খন্দকার আবদুর রশিদ ও শরিফুল হক ডালিমকে কখনো স্পেন ও কখনো পাকিস্তান, আবদুল মাজেদকে সেনেগাল এবং মোসলেমউদ্দিনকে জার্মানিতে দেখা যাওয়ার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। জার্মানি, স্পেন ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মিশন ২০১৭ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেমউদ্দিন ওই তিন দেশে অবস্থান করছেন না।
এদিকে লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা জানান, ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের আগ পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই লিবিয়ায় অবস্থান করতেন খন্দকার আবদুর রশিদ। উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ওই খুনি গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য ব্যবসা করতেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান আজিজ পাশা।