খবর৭১ঃ
ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সোমবার (১২ আগস্ট) অনুষ্ঠিত হয়েছে কোরবানির ঈদ। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে সেই চামড়া চলে যাচ্ছে চামড়ার পাইকারি বাজার লালবাগের পোস্তায়। সেখানে শুরু হয়েছে চামড়া সংগ্রহ ও কেনাবেচা।
তবে গত বছরের তুলনায় এবছর চামড়ার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন চামড়া ভালো আছে, রাতে এ চামড়ার মান নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আরো দাম কমে যাবে। এমন আশঙ্কার পাশাপাশি সঠিক নিয়মে চামড়া সংরক্ষণ না করার কারণে এবছরও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানান তারা।
এদিকে গত বছর থেকে এবছর প্রতিটি চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এবছর প্রতি পিস ছোট চামড়ার দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, গতবছর যা বিক্রি হয়েছিল এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা এবং বড় চামড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা।
সরেজমিন দেখা যায়, লালবাগের পোস্তায় বিকেল ৩টার পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে কোরবানির চামড়া আসতে থাকে। আড়তদারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠেছে লালবাগের শায়েস্তা খান, রাজ নারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন রোড। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন। তবে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় এবার ৫০ শতাংশ আড়তদার কমে গেছে। কিন্তু পশু কোরবানি এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পোস্তায় এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি কাঁচা চামড়ার বেচা-কেনা। রাতের দিকে পুরোদমে চামড়া কেনাবেচা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়তে প্রতিবারের মতো এবারো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া আসবে বলে প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের। এখানে চামড়া লবণজাত করার পর তা চলে যাবে সাভারের ট্যানারিপল্লিতে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, কোরবানির চামড়া মাত্র আসতে শুরু করেছে। তবে রাতের দিকে রাজধানীর সব স্থান থেকে চামড়া আড়তে আসবে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এ বছর প্রায় এক কোটি কোরবানির পশুর চামড়া আমদানি করার টার্গেট আছে। তবে আমরা রাজধানী থেকে প্রতি বর্গফুট লবণছাড়া চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় সংগ্রহ করছি। সে হিসাবে ছোট প্রতি পিস চামড়ার দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং বড় দুই হাজার থেকে ২৫ স্কয়ার ফুট চামড়ার দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, সব মিলিয়ে এবছর চামড়াখাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে। ট্যানারি মালিকরা সাড়ে তিনশ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রেখেছেন। অন্যান্য ঈদের সময় ১০ থেকে ২০ শতাংশ নগদ টাকা দিলেও এবার সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন টাকা পেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা টাকা না পেলে চামড়া কিনবেন কিভাবে। ফলে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। যারা টাকা পেয়েছেন তারা চামড়া কিনছেন। তাই এবছর আমাদের ২৪৫ জন আড়তদারের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন আড়তদার চামড়া কিনতে পারছেন।
তিনি বলেন, এখাত দিনদিন নিন্মমুখি হচ্ছে। এজন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালাসহ ট্যানারি মালিকদের জমি দ্রুত রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে।
এছাড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থান থেকে বেশি দামে চামড়া কিনছেন। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে যারা চামড়া কিনবেন তাদের দায়ভার সংশ্লিদেরই নিতে হবে।
তারা একদিকে চামড়ার সিলেকশন বোঝে না, অপরদিকে, স্কয়ার ফুট না বুঝে পশুর চামড়া ক্রয় করছেন। তাই আড়তদারদের দোষারোপ করছেন। এ সুযোগে এক শ্রেণীর চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী কমদামে চামড়া কিনে মজুদ করবে ফলে চামড়ার দর পতন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঠিক নিয়মে লবণ দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করার আহ্বান জানান মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।
সূত্র জানায়, সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি কারখানাগুলোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তবে আজ সেখানে কাঁচা চামড়া যাচ্ছে না। লবণ দেওয়া চামড়া যাবে। চামড়া সেখানে যেতে ২/৩ দিন সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কোরবানি ঈদ এলে হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে সিন্ডিকেটের। এ ব্যাপারে কারো কোনো হস্তক্ষেপ চোখে পড়ে না। ফলে তারা যাচ্ছে-তাই করে বলে মাঠ পর্যায়ের ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।
পোস্তার আড়তদার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করি। এবারের মতো দরপতন কোনোদিন দেখিনি। এবার চামড়া কম দামে কিনেও ঝুঁকিতে আছি। এখনো কোনো ট্যানারি যোগাযোগ করেনি। আশা করছি, আগামী রোববার (১৮ আগস্ট) থেকে চামড়া নেওয়া শুরু করবেন ট্যানারি মালিকরা।
তিনি জানান, এবার তার গুদামে ২ হাজার ৫০০ পিস চামড়া সংগ্রহ করবেন। মানভেদে ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত দামে চামড়া কিনেছেন। আর চামড়া প্রতি তার খরচ হয়েছে ২৫০ টাকা। এ খরচের মধ্যে রয়েছে লবণ মাখানো, গাড়িতে করে চামড়া আনা ও লবণ খরচ। সরকার নির্ধারিত ৫০ টাকা ফুট বিক্রি করতে পারলে লাভবান হবেন আড়তদাররা।
রোববার থেকে ট্যানারি মাল টানা শুরু করবেঃ
মৌসুমি ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জানান, সকাল ৮টায় যে পশুগুলো কোরবানি হয়েছে সেগুলোর চামড়া পোস্তায় আনতে বেশি সময় লাগেনি। তবে এখানকার আড়তদাররা সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কিনতে রাজি হচ্ছে না। তারা অল্প দাম দিতে চায়। তিনি বলেন, আনুমানিক ২৫ বর্গফুট হবে এমন ৪টি চামড়া গড়ে ১২০০ টাকা করে কিনেছি। সরকারি দাম ফলো করা হয়েছে। চামড়ায় যে বিনিয়োগ করেছি, সে অনুসারে আড়তদারেরা চামড়া ক্রয় করতে রাজি নন।
আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, আড়তদারেরা নির্ধারিত দামের চেয়ে কমে চামড়া কিনছেন। এখন চামড়া বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ করে চামড়া কিনে আর্থিক সংকটের কবলে পড়তে হবে। আমরা চামড়ার জন্য যে পরিমাণ টাকা ইনভেস্ট করেছি, বিক্রি করতে দেরি হলে পুরো টাকাই লোকসান হবে। তাই লোকসান কমাতে তাদের কাছেই চামড়া বিক্রি করতে হবে।