খবর৭১ঃ গত বছর আগস্ট থেকেই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ভাণ্ডার মশার ওষুধশূন্য হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে ওই মাসেই ডিএনসিসি ১ লাখ লিটার মশার ওষুধ ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু কর্পোরেশনের নিজস্ব ও বাইরের দুটি সংস্থার টেস্টিং রিপোর্টে সে ওষুধ অকার্যকর ও নিম্নমানের শনাক্ত হওয়ায় তা ফেরত দেয়া হয়।
যে কোম্পানি এই অকার্যকর ও নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করেছিল তার নাম লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট লিমিটেড। অভিযোগ আছে পরপর দুটি চালানে লিমিটের ওষুধ অকার্যকর শনাক্ত হওয়ার পরও সিটি কর্পোরেশনের একটি সিন্ডিকেট ভালো ওষুধ সরবরাহের জন্য কোম্পানিকে বারবার সময় দিতে থাকে।
৪ মাস কেটে গেলেও কোম্পানিটি ভালো ওষুধ দিতে পারেনি। ভয়াবহ এই প্রতারণার পরও সিটি কর্পোরেশনের ওই সিন্ডিকেট লিমিটকে ব্ল্যাকলিস্ট করেনি। অভিযোগ আছে, এই সুযোগে লিমিট অ্যাগ্রো উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ফেরত দেয়া সেই অকার্যকর ওষুধের চালান বিক্রি করে দেয় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে।
যার কারণে এক বছর ধরে কার্যত কোনো ধরনের মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি ঢাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত এই কারণে ডেঙ্গু মশা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।
অপরদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পূর্ণাঙ্গভাবে মশক নিধন করতে হলে সিটি কর্পোরেশনকে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ওষুধ ছিটাতে হবে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন ছিটাচ্ছে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে। এতে উড়ন্ত মশা মরলেও মশার ডিম, লার্ভা ও পিউপস মরেনি কখনও।
কারণ এই তিনটির জন্ম পানির নিচে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এই সময়ে (আগস্ট-জুলাই) ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ ছিটানোর নামে যা করেছে তা ছিল আইওয়াশ ও ধোঁয়াশা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আইসিডিডিআরবি’র রিপোর্টে মশার ওষুধ নিয়ে যে পরীক্ষা করা হয়েছে তার নমুনা ছিল মূলত লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট লিমিটেডের সরবরাহকৃত ওষুধের। কিন্তু ডিএনসিসি আমেরিকান একটি কোম্পানির কাছ থেকে গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ লিটার মশার ওষুধ ক্রয় করেছে। এই ওষুধের নমুনা ডিএনসিসিসি’র নিজস্ব টেকনিক্যাল কমিটির পরীক্ষার পাশাপাশি সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইডিসিআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতাধীন উদ্ভদ সংরক্ষণ উইংয়ে পরীক্ষা করানো হয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ৩ পরীক্ষায়ই আমেরিকান ওই কোম্পানির ওষুধ কার্যকর বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সিটি কর্পোরেশনের টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান হলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এই কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা, আইডিসিআর প্রতিনিধি, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের প্রতিনিধি প্রমুখ।
নিয়ম হচ্ছে- কোনো কোম্পানি ওষুধ সরবরাহের পর নমুনা সংগ্রহ করে প্রথমে সিটি কর্পোরেশনের টেক কমিটি তাদের লাবরেটরিতে পরীক্ষা করেন। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল বাকি দুটি সংস্থার কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। জানা গেছে, আমেরিকান ওই কোম্পানিটির নাম নোকন লিমিটেড। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিডা) গত ৬ নভেম্বর ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী নোকন লিমিটেডের ইনভেস্টরের নাম সাকির কারসাজ।
তার জাতীয়তা ও পাসপোর্ট নম্বর বিভাগে লেখা আছে আমেরিকান ৫৪৮৪৮৪৬১৫। বিডার সহকারী পরিচালক শেখ রাসিবুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে এই বিনিয়োগাকারীকে ২ বছরের জন্য ওয়ার্ক পারমিট দেয়া হয়। রোববার দুপুরে টেলিফোনে নোকন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকির কারসাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, তারা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে গত মার্চ মাস থেকে কয়েক দফায় প্রায় আড়াই লাখ লিটার মশার ওষুধ সরবরাহ করেছেন। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, ওষুধে কোনো ভেজাল নেই। এই ওষুধ ছিটালে এডিসসহ যে কোনো মশা, মশার ডিম, লার্ভা মরতে বাধ্য। প্রয়োজনে তিনি আইসিডিডিআরবিসহ সরকারের বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে তার ওষুধ পরীক্ষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, চায়না থেকে তারা মশা মারার মূল ওষুধ নিয়ে আসেন। পরে গাজীপুরে তাদের ওষুধ তৈরির কারখানা আছে। সেখানে ওষুধ তৈরি করে বিভিন্ন সংস্থার কাছে সরবরাহ করেন।
প্রতি লিটার ২৬৯.৬৬ টাকা দরে তারা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে ৪ লাখ লিটার ওষুধ সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছেন গত বছরের শেষদিকে। জানা গেছে, এর আগে লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্টের যে ওষুধ সিটি কর্পোরেশনের পরীক্ষায় অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল সে ওষুধের দর ছিল প্রতি লিটার ২৪৮ টাকা। ওই দরপত্রে নোকন লিমিটেড দর দিয়েছিল প্রতি লিটার ৩২৬ টাকা। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়ায় সে সময় নোকন কার্যাদেশ পায়নি। যেভাবে লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট ব্ল্যাকলিস্ট হয় : ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১ লাখ লিটার মশার ওষুধ সরবরাহে
উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করে। ইজিপিতে সে সময় ৫টি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হয় লিমিট লিমিটেড। তাদের দর ছিল ২৪৮ টাকা প্রতি লিটার। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর লিমিটকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রথম চালানে লিমিট ৫০ হাজার লিটার ওষুধ সরবরাহ করে। সিটি কর্পোরেশনের ভাণ্ডারে পৌঁছার পর টেক কমিটির সব সদস্যের সামনে তা পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষার জন্য মশারি দিয়ে ৩টি বড় আকারে খাঁচা তৈরি করা হয়। প্রতিটি খাঁচার মধ্যে গড়ে ১শ’ থেকে দেড়শ’ মশা রাখা হয়। সব ধরনের মশা থাকে এসব খাঁচায়। এরপর সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা ফগিং মেশিনের মাধ্যমে ওই ৩টি খাঁচায় ওষুধ ছিটিয়ে দেয়।
টেক পরীক্ষায় প্রথমে দেখা হয় ওষুধে ধোঁয়া হয় কিনা। ফগিং করার ২০ মিনিট পর দেখা হয় কতগুলো মশা নিচে পড়ে গেছে। এই পরীক্ষায় যদি ৮০ শতাংশের বেশি মশা নিচে পড়ে যায় তাহলে ওই খাঁচা ২৪ ঘণ্টার জন্য একটি বিশেষ কক্ষে সিলগালা করে রাখা হয়।
২৪ ঘণ্টা পর দেখা হয় মোট কত শতাংশ মশা মারা গেছে। যদি সেখানেও ৮০ শতাংশের বেশি মশা মারা যায় তাহলে ওই ওষুধের নমুনা পরবর্তী দুটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।
কিন্তু পরীক্ষায় লিমিট অ্যাগ্রোর ওষুধে কোনো মশা মরেনি। যে কটি মশা ধোঁয়ায় নিচে পড়ে গিয়েছিল ২৪ ঘণ্টা পর সেগুলো আবার জীবিত হয়ে যায়। এই অবস্থায় লিমিটকে বলা হয়, তারা এই ৫০ হাজার লিটারের চালান নিতে পারবে না।
কিন্তু লিমিট চেষ্টা-তদবির করে আরেক দফা ৭০ হাজার লিটার ওষুধ পাঠায় লালবাগে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গোডাউনে। প্রথম দফায় গুলশানের গোডাউনে মালামাল দেয়ার পর দ্বিতীয় দফায় কৌশলে সেখানে আর ওষুধ দেয়নি। এরপর দ্বিতীয় দফায় পাঠানো ওষুধও পরীক্ষা করে টেক কমিটি। এবারের ওষুধ আরও বেশি অকার্যকর। এতেও লিমিট খান্ত হয়নি। নানা চেষ্টা-তদবির করে ভালো ওষুধ দেয়ার জন্য আরও সময় চান।
এভাবে তারা একাধিকবার সময় নিয়ে যতবারই ওষুধ দিয়েছে ততবারই সিটি কর্পোরেশনের টেক পরীক্ষায় তা অকার্যকর হয়। এক পর্যায়ে সিটি কর্পোরেশন দেখে রাজধানীতে মশা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে গত বছরের শেষদিকে ১ লাখ লিটার মশার ওষুধ সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। দেখা গেছে, ওই দরপত্রেও লিমিট ২১৭ টাকা দর দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। আর নোকন লিমিটেড দর দেয় ২৬৯.৬৬ টাকা।
এই অবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের একটি অংশ সিদ্ধান্ত নেয় লিমিটকে ব্ল্যাকলিস্ট করার। কারণ এই দফায় যদি তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয় তাহলে আবারও প্রতারণার শিকার হতে হবে তাদের। যদিও সিটি কর্পোরেশনের একটি সিন্ডিকেট এ নিয়ে বড় ধরনের হৈচৈ বাধানোর চেষ্টা করেছিল। এক পর্যায়ে লিমিটকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয় তাতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে যায় নোকন লিমিটেড।