খবর৭১ঃ আসন্ন ঈদুল আজহার সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও প্রকট হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা থেকে কমপক্ষে অর্ধকোটি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় যাবেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকে থাকবেন। যাদের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এ রোগ। তবে ওই সময় টানা বৃষ্টিপাত হলে অথবা কয়েকদিন রোদ থাকলে ডেঙ্গু বিস্তারের শঙ্কা নেই। বরং বর্তমান প্রকোপের মাত্রা কমে আসবে। কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশে যদি থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বেশ চিন্তিত। শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেঙ্গু সেল পরিদর্শনকালে তিনি বলেছেন, আমাদের চিন্তা ঈদের সময়টা নিয়ে। সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মীর ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ডাক্তাররা দিনরাত কাজ করছেন। সার্বিক বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কাজ করছি। কিট, স্যালাইন, ডাক্তার, নার্সের অভাব নেই। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।
তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলছেন, কোনো কিছুর যেন অভাব না হয়। রিএজেন্টের কিছু অভাব ছিল। আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। টেস্টিং কিটের কিছু অভাব দেখা দিয়েছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ডিজি ড্রাগকে বলেছি। তারা ৫০ লাখ কিটের অনুমোদন দিয়েছে। ইতিমধ্যে দুই লাখ কিট চলে আসছে।
এদিকে ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৬৪৯ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৯১৯ জন। শনিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে। তবে বেসরকারি হিসাবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের গ্রামের বাড়িতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। অনেক গ্রাম্য এলাকায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকেন না। সেক্ষেত্রে সুচিকিৎসার অভাবে প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
অধ্যাপক আজাদ বলেন, বর্তমানে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ অবস্থায় বাড়িতে না যাওয়াই ভালো। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার কামড় খেয়ে জ্বর নিয়ে কেউ গ্রামে গেলে এবং ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে গ্রামের মশা কামড়ালে সেই মশার মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমিত হয়ে অন্যরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সে কারণে জ্বর নিয়ে গ্রামে ঈদ করতে যাওয়াটা ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, আমরা বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসারত ডেঙ্গু রোগীদের বিষয়ে জানতে পেরেছি যে, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে বাড়িতে গিয়ে ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। এ কারণেই আমরা আসন্ন ঈদে রাজধানীবাসী যাদের শরীরে জ্বর থাকবে তাদের গ্রামে ঈদ করতে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু মোটামুটি সক্রিয়। উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা মাঝারি অবস্থায় আছে। ১০ আগস্টের দিকে তা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে স্থলভাগে উঠে যেতে পারে। এরপর তা একদিকে সারা দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে। পাশাপাশি ভারতের পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে মেঘালয়, আসাম, সিকিম, হিমাচল, অরুনাচল, পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপাল ও ভুটানে বিস্তৃত হতে পারে। ফলে ১০ আগস্টের পর থেকে প্রায় সারা দেশে বৃষ্টিপাত হতে পারে। তাই এবারের ঈদুল আজহা হতে পারে বৃষ্টিস্নাত।
ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শফি উল্লাহ মুন্সি বলেন, ডেঙ্গু অন্যান্য ফ্লুর মতো একটি ভাইরাস জ্বর। ডেঙ্গু ভাইরাস অন্য ভাইরাসের মতো অনুকূল পরিবেশে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। আক্রান্ত মানুষকে কোনো এডিস ইজিপ্টি বা এডিস এলবোপিকটাস মশা যদি কামড় দেয়, তাহলে ওই মশা ডেঙ্গুর বাহকে পরিণত হয়। একটি এডিস মশা খাদ্যের চাহিদা পূরণে পাঁচজনকে কামড়াতে পারে। অর্থাৎ একটি এডিস মশা দ্বারা ৫ জন মানুষের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের আশঙ্কা থাকে।
মুগদা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম শামসুজ্জামান বলেন, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত এডিস মশার প্রজননে সহায়ক ভূমিকা রাখে। যদি ঈদের আগে সে ধরনের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। তাছাড়া এডিস মশার দুটি জাত রয়েছে। একটি এডিস ইজিপ্টি। এটি শহুরে মশা। এর মাধ্যমেই ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আরেকটি এডিস এলবোপিকটাস। এটি মূলত গ্রাম এলাকার মশা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা করে দেখেছে, এ মশাও ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর বাহকে পরিণত হয়েছে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ঈদে গ্রামে গেলে এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ঈদের সময় অসংখ্য মানুষ বাড়িতে যাবে। তাদের সঙ্গেও ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। বাস, ট্রেন, লঞ্চে যাত্রার আগে মশা নিধন করা হবে না। তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর চিকিৎসকদের ডেঙ্গু বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সেটি ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই ঈদের সময়ে যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগটি ছড়াতে থাকবে, তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে প্রথম জেলা-উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
ঈদে সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সবার ছুটি স্থগিত করা হয়েছে। সোমবার সোসাইটি অব মেডিসিনের উদ্যোগে ১৩টি টিম দেশের বড় ১৩টি মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গুবিষয়ক সায়েন্টিফিক সেমিনারের আয়োজন করেছে। সেমিনারগুলোতে মেডিকেল কলেজসহ আশপাশের সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা অংশগ্রহণ করবে।
এছাড়া ৭ ও ৮ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হবে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে সব জেলার সিভিল সার্জনের কাছে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালগুলোকে এমএসআর’র (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুজিট) মাধ্যমে ডেঙ্গুসংক্রান্ত সরঞ্জাম কিনতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক সানিয়া বলেন, আমরা যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। তবে আবহাওয়া যদি অনুকূলে না থাকে তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে।
এদিকে এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পিএম ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান জানান, আসন্ন ঈদে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো হল- ১. আগামী ৫ আগস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আয়োজনে দেশের ১৩টি মেডিকেল কলেজে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মাধ্যমে মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশিক্ষক দল মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবেন।
২. সারা দেশের সব জেলায় ন্যাশনাল গাইডলাইনের কপি পাঠানো হয়েছে এবং আগামী ৭ তারিখ থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তারদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। ৩. ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে তথ্য দিয়ে জনগণকে সঠিক পথে উদ্বুদ্ধ করতে ৫ আগস্ট বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের ওরিয়েন্টেশন আয়োজন করা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিঃ স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপেরেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৪৯ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে আগস্ট মাসের প্রথম তিন দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৮৪ জন। একই সময়ে রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে ভর্তি হয়েছে ২৩৮১ জন। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৯১৯ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ হাজার ৪৭ জন এবং চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৬ হাজার ৮৫৮ জন। এই সময়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮ জন। যদিও প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি পরিদর্শনঃ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যন মন্ত্রী জাহিদ মালেক শনিবার রাজধানীর পাঁচ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। এই পাঁচ হাসপাতাল হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট ও ঢাকা শিশু হাসপাতাল।