খবর৭১ঃ বন্যাকবলিত জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জে পানির নিচে তলিয়ে গেছে ৬০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল। কয়েকহাজার পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ হলেও ত্রাণের অপ্রতুলতায় অনেকেই ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
বিশুদ্ধ পানির অভাব, গো-খাদ্য সংকট বন্যার্তদের দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বেড়েছে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। গতকাল বন্যায় সাত শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। পানি হ্রাস অব্যাহত থাকলেও গতকাল দেশের নদ-নদীর ২১টি পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ইত্তেফাকের আঞ্চলিক অফিস, জেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা সংবাদদাতাদের পাঠানো খবরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বন্যা পরিস্থিতি আরো উন্নতির সম্ভাবনা: পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গা ও পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা নেই। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাত শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু: জামালপুরের বকশীগঞ্জে বন্যায় তিন শিশুসহ ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। এক জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেরপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল জেলা সদর ইউনিয়নের সূর্যনগর পূর্ব পাড়া গ্রামে শাহীন মিয়ার মেয়ে স্বজনী খাতুন (১২), সোলায়মান হোসেনের মেয়ে সাথী বেগম (১০) ও মাসুদ মিয়ার মেয়ে মৌসুমী আক্তার (৮) ভেলায় করে বানের পানি দেখতে যায়। এসময় তারা পানিতে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই স্বজনী ও সাথী মারা যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় মৌসুমীকে শেরপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একইদিন মেরুরচরের রবিয়ারচর গ্রামে পা পিছলে বানের পানিতে পড়ে মারা যান আবদুল শেখ (৭০) নামে এক বৃদ্ধ। ঘুঘরাকান্দিতে বানের পানিতে পড়ে তিনদিন নিখোঁজ পৌর শহরের সীমারপাড়া গ্রামের শাজাহান মিয়ার ছেলে সুজনের (২২) লাশ উদ্ধার হয় গতকাল।
পানিতে পড়ে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কুতুবেরচর এলাকার ইয়াছিন মিয়ার শিশু স্বাধীন (৪) মারা গেছে। অপরদিকে শনিবার রাতে সাপের কামড়ে রাজা-বাদশা (৫৫) নামে একজন মারা যায়। একই জেলার মাদারগঞ্জে জোড়খালির নুরুল ইসলামের আরাফাত (২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে গতকাল বন্যার পানিতে ডুবে আরো তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরা হলো, উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের জিরাই গ্রামের আব্দুল মজিদের কন্যা জান্নাতি (১০), গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের গুমানি গ্রামের শাহ আলমের কন্যা নিশাত (৪) ও তালুককানুপুর ইউনিয়নের সুন্দইল গ্রামের টিক্কা মিয়ার পুত্র হাবিব (২)।
এদিকে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে বন্যাকবলিত বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল কম। বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি কমতে থাকায় কৃষকের মধ্যে ফসল হারানোর কষ্ট বাড়তে শুরু করেছে।
গাইবান্ধায় তলিয়ে গেছে প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এ জেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে পাউবোর বাঁধে, সড়কে, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে ও নৌকায় এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে।
কুড়িগ্রামে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। উলিপুরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বহির্বিভাগে চিকিত্সা নিয়েছেন ৩২০ জন। এখনো ঘরে ফিরতে পরছে না দুর্গতরা।
বন্যায় জেলার ৫৭টি ইউনিয়নের ৮৯৪টি গ্রামের ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল। জামালপুর জেলায় প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর জমি ও সিরাজগঞ্জে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামালপুর-শেরপুর যোগাযোগ তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে ভাঙনঃ তিস্তার ভাঙনে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ২৫টি পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচরে তিনটি ইউনিয়নে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে কয়েকশ পরিবারের বাড়িঘর ও একটি মাদ্রাসা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে তিনটি স্কুল, ঝুঁকিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা। একই নদীর ভাঙনে ফরিদপুরের সদরপুরে গত এক সপ্তাহে ২ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে ভাঙনে বিলীন হয়েছে ৭০টি পরিবারের ঘরবাড়ি।
৩০ বছর পর বড়াল নদীতে স্রোতঃ পাবনার চাটমোহরে বন্যায় উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর বড়াল নদীতে স্রোত দেখা গেছে। ১৯৮১ সালে রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে বড়ালের উত্সমুখে ও পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার সীমান্ত এলাকা দহপাড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দুইটি জলকপাট নির্মাণ করে। দিনে দিনে দখল-দূষণে ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বড়াল পরিণত হয় মরা খালে। এরপর এই প্রথম বড়ালে দেখা দিল স্রোত।