খবর৭১ঃ
ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানের বদলে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ভারতকে। সঙ্গে আছে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান আর মালদ্বীপ। চীন ঠেকাতেই নাকি নতুন এই মার্কিন নীতি। ঈদের পর খবরটা চোখে পড়েছিল। খবরটা হজম করতে না করতেই চোখে পড়ল আরেকটা খবর। গত মাসে মার্কিন কংগ্রেসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক শুনানিতে একজন সিনিয়র কংগ্রেসম্যান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের নতুন একটা ফর্মুলা বাতলিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া প্রস্তাব করেছেন। তার যুক্তি, দক্ষিণ সুদানকে সুদান থেকে আলাদা করাটা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করতে পারে তাহলে এখানে সমস্যা কোথায়? রাখাইনেও তো গণহত্যা হয়েছে, লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। শুনানিতে উপস্থিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা অবশ্য এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি।
ক’দিন আগে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় লিভার এ্যাসোসিয়েশনের একটি সম্মেলনে বক্তৃতা করার সুবাদে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে যাবার সুযোগ হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক অধিবেশনের ফাঁকে বাকুতে ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় টুরিস্ট গাইডের একটা কথা একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধল। ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘রুশরা যখন কোন দেশে যায় তখন তারা যায় ‘রক্ষা’ করতে, আর মার্কিনীরা যায় ‘মুক্ত’ করতে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই দুইয়ের হাত থেকে রক্ষা করুন।’
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে এদেশের রাজনীতিতে আমরা অদ্ভুত কিছু দেখেছিলাম। হঠাৎই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন অচল কিছু রাজনীতিবিদ। প্রগতিশীল ঘরানার প্রতিনিধিত্বের দাবিদার একজন আইনজ্ঞ ছিলেন পুুরো প্রক্রিয়ার মধ্যমনি। ১/১১-তে তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। পরবর্তী সময়ে সামনে চলে আসে একাত্তরের ন’টি মাসে তার দেশবিরোধী ভূমিকার কথাও। নির্বাচনের আগে তিনি অবতীর্ণ হন ‘কা-ারির’ ভূমিকায়। ‘আমি ওর বন্ধু আর ও তার বন্ধু, কিন্তু আমি তার বন্ধু না’ জাতীয় জটিল সমীকরণ জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। সর্বশেষ নির্বাচনে জাতি প্রত্যাখ্যান করেছে তার অসুস্থ রাজনীতিকে।
নির্বাচনের পরপরই দেখলাম ষড়যন্ত্রের নতুন আঙ্গিক। একদল জামায়াতি হঠাৎই ভোল পাল্টে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় নেমে পড়ল। জাতি নাকি তাদের ‘জনআকাক্সক্ষা’ পূরণের দায়িত্ব দিয়েছে। প্রেসক্লাবে ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করে তারা শুরু করতে চেয়েছিল জাতিকে আরও একবার ঘোল খাওয়ানোর মহাযজ্ঞ। জানা গেল লন্ডনে পালিয়ে বেড়ানো একজন চিহ্নিত আল বদর এই মঞ্চের নেপথ্যে। ক’দিন আগেও দেশে বসে যুদ্বাপরাধীদের হয়ে আদালতে ওকালতিতে ব্যস্ত ছিল এই পলাতক উকিল। পরে একাত্তরের কৃতকর্ম জানাজানি হওয়ায় দেশ ছাড়ে। আর এখন সহসা আবিষ্কার করেছে একাত্তরে জামায়াতের কাজগুলো ছিল ভুল। এখন সেসব ভুলে জনতার প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। এ যাত্রায়ও ফলাফল অবশ্য আপাতত শূন্যই। মানুষ ঘোল খায়নি।
গায়ে মানে না আপনি মোড়লের আমদানি হয়েছে ইদানীং রাজনীতিতে। পথভ্রষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার মুখোশের আড়ালে যুগে যুগে রাজাকার পুনর্বাসন আর জাতিকে বিভ্রান্ত করার মহাযজ্ঞে সক্রিয় থেকেছেন। ছিলেন পঁচাত্তরের পর ‘রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা’ নিয়ে গঠিত এদেশের প্রথম সরকারে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন ম্যাডামের মন্ত্রিসভায়ও। পরে ছেলের প্যাদানিতে দল ছেড়েছেন। কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে জোটে ফিরেছিলেন। ইদানীং ম্যাডামের মুক্তির দাবিতে তার মায়াকান্না দেখে মাঝে মধ্যে মনে হয় ‘মা’র চেয়ে মাসীর দরদ’ আসলেই বেশি। উনি এখন ‘ডানে জামায়াত, বাঁয়ে মুক্তিযোদ্ধা’ নিয়ে ‘সেদিনের জামায়াত নিন্দনীয়, আর এদিনেরটা পূজনীয়’ স্লোগান মুখে মাঠে নেমেছেন। সম্ভবত এই উদ্যোগও সফল হবে না।
প্রাথমিক আলামতটুকু অন্তত সে রকমই। বাংলাদেশের প্রতি বৃহৎ পরাশক্তির সাম্প্রতিক এই আগ্রহ আর দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক এসব অদ্ভুতুরে ঘটনাগুলোর মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে কিনা তা বিশ্লেষণের প্রজ্ঞা আমার নেই। আমি শুধু জানি এসব অন্ধকারের কুশীলবদের অতীত কালিমায় কালো। আমি জানি আমার আরাকান চাই না। এই বেশ ভাল আছি। উন্নতি করছি শনৈঃশনৈ। মানুষ দুটো খেয়ে পড়ে ভালই আছে, আর আমি আছি ২০২১-এর উন্নত বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশায়।
রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় পাশে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। দু’বছর ব্যবধানে আজ বিপর্যস্ত আমাদের পরিবেশ, স্থানীয় অর্থনীতি, শিক্ষা, কি-ই না? তার চেয়ে বড় কথা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা। খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যার সমাধান না পাওয়া গেলে, শুধু দক্ষিণ এশিয়া কেন গোটা এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাও এখন দৃশ্যমান। আর এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানান দিতে এখন আর রাখ-ঢাক করছেন না বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্তারাও। আমি চাই না আমার আঙ্গিনায় নাক গলাক কোন পরাশক্তি, পরোপকারের নামে পরাধীনতায় আরেকবার বাধতে আমায়। আমি শুধু চাই ওদের লোকগুলোকে ওরা আরাকানে ফিরিয়ে নিক। তাতেই আমি ঢেড় খুশি!
এই লেখাটি যখন লিখছি ইমেরিটাসের বিমান তখন বাকু থেকে দুবাইয়ের পথে মধ্য এশিয়ার আকাশে। সিটের সঙ্গে জুড়ে দেয়া মনিটরে ভেসে উঠছে একের পর এক নাম করা শহরের নাম। হঠাৎ মনে আসল ইরানের পতিত শাহের অমর একটি উক্তি, ‘ওরা যদি কারও বন্ধু হয়, তার শত্রুর প্রয়োজন নেই’। মনে পড়ল শাহের ছেলে প্যারিসের পাঁচ তারকা হোটেলে বছরের পর বছর বন্দী থাকতে থাকতে এক সময় ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যাকেই মুক্তির পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন? সত্যি-ই কি অদ্ভুত মুক্তি!