খবর৭১ঃ
ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় গতকাল রবিবার সার্বিকভাবে দেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিপদসীমা অতিক্রম করেছে আরো কয়েকটি নদী। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও বাড়িঘর। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে রয়েছে বন্যাদুর্গতরা।
বান্দরবানে বিভিন্ন বাসাবাড়ির দোতলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এখানে পাহাড়ধস ও খালে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তিনজন। কক্সবাজারের চকরিয়ায় পৃথক পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে এক দম্পতি। জামালপুরে বন্যার পানিতে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে এক শিশু।
একাধিক স্থানে ভাঙনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। শেরপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের এক শ ফুট ধসে গেছে। লালমনিরহাটে তিস্তার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের জন্য জরুরি খাদ্য ও নগদ সহায়তার উদ্যোগ নিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম।
আমাদের ব্যুরো ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিতঃ
সিলেটঃ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার চারটি উপজেলার বেশির ভাগ এবং দুটি উপজেলার আংশিক প্লাবিত হয়েছে। বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার ওপরে। অনেক এলাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ।
হবিগঞ্জঃ জেলায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফুলে-ফেঁপে উঠছে হাওর। কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের কমপক্ষে ৫০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। খোয়াই নদ বিপত্সীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত কুশিয়ারা গতকাল দুপুরে বিপত্সীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নবীগঞ্জের দীঘলবাক এলাকায় বাঁধ ভেঙে আটটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মৌলভীবাজারঃ জেলায় মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর পানি গতকাল বিকেল ৩টায় বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনায় কুশিয়ারা নদীর তীর দিয়ে নির্মিত গ্রামের রাস্তা উপচে আসা পানিতে তিনটি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। কমলগঞ্জ উপজেলার পৌরসভা এলাকায় ধলাই নদ রামপাশা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে রামপাশা ও কুমড়াকাপন প্লাবিত করেছে।
সুনামগঞ্জঃ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ১১ উপজেলারই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। সরকারি হিসাবে বন্যায় এক লাখ ৩০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা গেছে। তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি বিপত্সীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জগন্নাথপুরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বান্দরবানঃ জেলায় পাহাড়ধস ও স্রোতে ভেসে গিয়ে এক নারীসহ তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। বান্দরবান শহরের বেশ কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। অসংখ্য ভবনের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত তলিয়ে গেছে। বান্দরবান ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, জেলখানা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ সাবস্টেশন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের পৌর পানি শোধনাগার, বাস টার্মিনাল, বান্দরবান সেনানিবাসের সদর দপ্তর, সামরিক হাসপাতাল এলাকা, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সরকারি বাসভবন, জেলার প্রধান ডাকঘর ও সরকারি গণগ্রন্থাগার ডুবে গেছে।
লামা-চকরিয়া সড়কের মিরিঞ্জা নামক স্থানে গতকাল সকালে পাহাড় ধসে পড়ায় লামা ও আলীকদমের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যা ও পাহাড়ধসে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবস্থা স্বাভাবিক করতে সেনাবাহিনী এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ কাজ করছে।
শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে লামা পৌরসভার মধুঝিরি এলাকায় পাহাড় ধসে একটি কাঁচা ঘরের ওপর পড়লে নূরজাহান বেগম (৫৫) নামে এক নারী নিহত হন। আহত হন তাঁর ছেলে ও পুত্রবধূ। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও এলাকাবাসী তাঁদের উদ্ধার করে।
এদিকে সদর উপজেলার পোড়াপাড়াসংলগ্ন পাহাড়ের ঢালে পেঁপেবাগানে কাজ করার সময় শনিবার বিকেলে পাহাড় ধসে পড়লে চাপা পড়ে প্রাণ হারান মেনপং ম্রো (২৫) নামের এক ব্যক্তি। এর আগে সদর উপজেলার মনজয় পাড়াসংলগ্ন হ্নারা খালে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হন অংচিংনু মারমা (৩৫)। গতকাল সকালে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
কক্সবাজার, চকরিয়াঃ ভারি বর্ষণের সময় কক্সবাজারের চকরিয়ায় ঘুমন্ত অবস্থায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছে এক দম্পতি। তাঁরা হলেন ওই এলাকার মৃত রবিউল আলমের ছেলে দিনমজুর আনোয়ার ছাদেক (৩৫) ও তাঁর স্ত্রী ওয়ালিদা বেগম (২২)। গতকাল ভোররাত ৩টার দিকে মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটেছে উপজেলার পাহাড়ি এলাকা বমু বিলছড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বমুরকূল এলাকায়।
চকরিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান জানান, পাহাড়ের পাদদেশে দিনমজুর আনোয়ার ছাদেকের বাড়ি। ভারি বর্ষণ চলাকালে শনিবার মধ্যরাতে পাহাড়ের বিশাল অংশ তাঁদের মাটির ঘরের ওপর ধসে পড়লে চাপা পড়ে মারা যান স্বামী-স্ত্রী।
এদিকে চকরিয়া ও পেকুয়ায় ২৫ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার সব গ্রাম তলিয়ে গেছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ।
জামালপুরঃ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানি বেড়ে যমুনা নদী বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপত্সীমার ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলার শতাধিক গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে।
মেলান্দহে মাহমুদপুর-উলিয়া রাস্তার খরকা এলাকায় কাঠের পুরনো সেতু ভেঙে যাওয়ায় ইসলামপুর উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দেওয়ানগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ পুরাতন রেলপথ কাম বাঁধ ভেঙে গেছে।
এদিকে মাদারগঞ্জে সাদিয়া আক্তার নামের সাত বছরের এক শিশু বন্যার পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছে। উপজেলার ঝাড়কাটা গ্রামে গতকাল বেলা ২টার দিকে সাদিয়া নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সবার অগোচরে বাড়ির কাছে বন্যার পানিতে পড়ে যায়। জামালপুর ফায়ার সার্ভিস গত রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত শিশুটির সন্ধান পায়নি।
শেরপুরঃ গতকাল সদর উপজেলার গাজীরখামার ও ধলা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ৩০ গ্রামের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সব মিলে সাত ইউনিয়নের ৩৫ গ্রামের ১১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। গতকাল দুপুরে নালিতাবাড়ীতে চেল্লাখালী নদী বিপত্সীমার ১ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এদিকে সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া এলাকায় গতকাল ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের এক শ ফুট ধসে গেছে। তলিয়ে গেছে বিপুল ফসলি জমি ও সাত শতাধিক বাড়িঘর।
লালমনিরহাটঃ বন্যার অবনতি হয়েছে আদিতমারী ও সদর উপজেলায়। গতকাল সকালে আদিতমারীর মহিষখোচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় এলাকায় তিস্তার একটি ওয়াপদা বাঁধ ভেঙে চণ্ডিমারী, বালাপাড়া, সিংগিমারী, দক্ষিণপালা পাড়া, গোবর্ধনসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গাইবান্ধাঃ তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ১১৩টি গ্রামের নতুন নতুন এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা।
রংপুরঃ চরম দুর্ভোগে পড়েছে রংপুরের পানিবন্দি পরিবারগুলো। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে গতকালও নদীর পানি বিপত্সীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তিস্তা। গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদী-কূলবর্তী ৫০টি গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার।
নীলফামারীঃ জেলায় নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। গতকাল ডালিয়ায় ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা বিপত্সীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শনিবার তা ছিল বিপত্সীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে।
ধুনট (বগুড়া)ঃ পানি বেড়ে যমুনা বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল সকাল ৬টায় বিপত্সীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ)ঃ সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় অস্বাভাবিক হারে পানি বেড়ে বিপত্সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে যমুনা নদী। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৪টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। নানা স্থানে স্থানীয় বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকছে পানি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ আখাউড়ায় গতকাল বিকেলে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে মোগড়া, মনিয়ন্দ ও দক্ষিণ ইউনিয়নের অন্তত ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর।