নতুন করে চেনা মরণব্যাধি হেপাটাইটিস বি

0
537
নতুন করে চেনা মরণব্যাধি হেপাটাইটিস বি
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল); চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

খবর ৭১ঃ

৯৬৫ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীর রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। রক্ত আর স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তমাখা সুইয়ের খোঁচায় ভাইরাসটি সংক্রমণের আশঙ্কা শতকরা ৩০ ভাগ। আর হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত মায়ের সন্তানের জন্মের পর পর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ ভাগ, তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমেও এ রোগ ছড়ায় না।

বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত। এদের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত, আর তাদের বেশিরভাগই জীবনের কোন এক পর্যায়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে আছেন। পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি রোগীরা ভাইরাসটির রিজার্ভার হিসেবে থেকে যান। তাদের কাছ থেকে যে কোন সুস্থ লোকের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এবং বাংলাদেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন। মহিলা, গর্ভবতী মা এবং নবজাতক শিশুদের বেলায় হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সারফেস এ্যান্টিজেন পজিটিভ হওয়ায় তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি কখনও কখনও নিজ দেশেও, চাকরির সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো যে, এদেশে বেশ কয়েক হাজার লোক প্রতিবছর হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত এদেশের ১০ শতাংশ লোকের চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক কথায় হেপাটাইটিস বি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা।

নতুন করে চেনা মরণব্যাধি হেপাটাইটিস বি

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৭০ ভাগ রোগীর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার কোন ইতিহাস থাকে না। শতকরা ১০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি আর প্রায় ৯০ ভাগ শিশু যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাদের লিভারে স্থায়ী ইনফেকশন দেখা দেয়। একে আমরা বলে থাকি ক্রনিক হেপাটাইটিস বি। এসব ব্যক্তিরাই ঐইংঅম পজিটিভ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের রোগীদের প্রায়ই কোন লক্ষণ থাকে না। এরা কখনও কখনও পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যথা, দুর্বলতা কিংবা ক্ষুধামন্দার কথা বলে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশে যাওয়ার সময় রক্ত পরীক্ষা করতে যেয়ে কিংবা রক্ত দিতে অথবা ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে রোগীরা তাদের হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনের কথা জানতে পারেন।

ক্রনিক হেপাটাইটিস বি এশিয়া ও প্রশান্ত-মহাসাগরীয় আরও অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, হেপাটাইটিস বি অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য একটি রোগ হলেও, এডভান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রন্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীরা প্রায়ই কোন শারীরিক অসুবিধা অনুভব করেন না। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ার পর হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ইনফেকশনের চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও রোগীকে আর সেভাবে সাহায্য করা সম্ভব হয় না।

বর্তমানে বিশ্ব বাজারে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন রয়েছে। বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন, কিন্তু হেপাটাইটিস বি-র চিকিৎসায় এসব ভ্যাকসিনের কোন ভূমিকা নেই। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান, হেপাটাইটিস বি রোগীর স্বামী বা স্ত্রী, স্বাস্থ্য কর্মী এবং থেলাসেমিয়া ও অন্যান্য হেমোলাইটিক এনিমিয়ার রোগীদের জন্য হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন নেয়া অত্যন্ত জরুরী। আর বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের হার যথেষ্টই বেশি, সেখানে প্রত্যেক নাগরিকেরই উচিত হেপাটাইটিস বি-র ভ্যাকসিন নিয়ে নেয়া। তবে ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কোন ভাল জায়গা থেকে, কারণ ঠিকমতো সংরক্ষণ করা না হলে এই ভ্যাকসিন কোন উপকারেই আসে না।

নতুন করে চেনা মরণব্যাধি হেপাটাইটিস বি

এতসব কিছুর মাঝেও সুসংবাদ এই যে, হেপাটাইটিস বি আজ আর কোন দুরারোগ্য ব্যাধি নয়। লিভারে সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়ার আগে এটি ধরা গেলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির নিরাময়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। পৃিথবীতে আজ এই ভাইরাসটির জন্য বেশ কয়েকটি ওষুধ রয়েছে যার সবই বাংলাদেশেও সহজলভ্য। এসবের মধ্যে পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন, এন্টেকাভির ও টেনোফোভির উল্লেখযোগ্য। আরও সুসংবাদ এই যে আমাদের দেশীয় একাধিক ওষুধ কোম্পানি এগুলো এদেশেই তৈরি করছে।

তবে চিকিৎসায় প্রত্যাশিত ফলাফলপ্রাপ্তি নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের ওপর। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোন রোগীকে হেপাটাইটিস বি-র যে কোন ওষুধ দিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে এমনটা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। এ জন্য অনেক সময় লিভার বায়োপসি করেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ ওষুধ নির্বাচনে কিংবা প্রয়োগে এতটুকু হেরফের হলে তাতে ভাইরাল রেজিস্টেন্স তৈরির পাশাপাশি রোগীর লিভারে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আশাব্যঞ্জক অনেক কিছুই। তাই তাদের উচিত হতাশ না হয়ে লিভার রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি-জনিত লিভার রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় প্রয়োজন আরও বেশি সচেতনতার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here