খবর৭১ঃ
রেলওয়ে উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই। নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। চলমান আছে অর্ধশত প্রকল্প। সেই সঙ্গে আছে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাও। এরই অংশ হিসেবে হাতে নেয়া হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দ্রুতগতিসম্পন্ন বুলেট ও বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার।
আর প্রতি বছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন। কিন্তু সবকিছুই এক রকম নিষ্ফল করে দিচ্ছে জরাজীর্ণ রেললাইন। যে পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে সেই রেলপথ দেখার যেন কেউ নেই। রেললাইন সংস্কার, মেরামত ও পরিদর্শনে এক রকম নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
বিভিন্ন সময় ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই রেল কর্তৃপক্ষের। দেশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও আখাউড়া-সিলেট রেলপথের প্রতিটি স্লিপারে সাজানো রয়েছে মৃত্যুফাঁদ।
লক্কড়-ঝক্কড় রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে স্লিপারে নেই নাট-বল্টু। এমনকি বাঁশ দিয়ে মেরামত করা হয়েছে রেলসেতু।
সরজমিনে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল স্টেশনের ১ কিলোমিটার দূরে আউট সিগনাল এলাকায় খালের উপর একটি ব্রিজে গিয়ে দেখা যায়, ওই ব্রিজের ৮টি স্লিপারে যেখানে ৬৪টি নাট থাকার কথা সেখানে এই ব্রিজে নাট আছে ৩৫টা। এর পাশেই দুটি পাতের সংযোগস্থলে একটিতে নেই নাট-বল্টু। অন্য দুটি যেন খুলে না যায় তাই আটকানো আছে দড়ি দিয়ে।
অপরদিকে এই ব্রিজের পাশে একটানা ৩০টি স্লিপারের কোনোটাতেই নাট-বল্টু নেই। প্রতিটি স্লিপারের দুইপাশে দুটি করে পেরেক মেরে রাখা হয়েছে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই এলাকায়।
রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তীকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দুইবার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫/৩০ হাজার যাত্রী।
স্থানীয় যুবক আবুল কালাম জানান, শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ২০টি ব্রিজ আছে যার অর্ধেকের বেশি সেতু বাঁশ দিয়ে মেরামত করা।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেলের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
অতিরিক্ত সচিব মজিবুর রহমান জানান, কুলাউড়ার ঘটনায় ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্ট পেয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুরো রেলওয়েতে যেসব সেকশনে এমন অবস্থা পাওয়া যাবে, সেই সব সেকশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো অবস্থায়ই একটি লাইনে স্লিপার নষ্ট কিংবা ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট খোলা থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে। তা যত দ্রুত সম্ভব মেরামত করা হবে।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হোসাইন আহমেদ জানিয়েছেন, মৌলভীবাজার-আখাউড়ায় রেললাইন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রেলপথ থেকে অব্যাহতভাবে চুরি হচ্ছে ক্লিপ-হুক। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলের গাফিলতি ও ক্লিপ-হুক চুরির ঘটনা ধরা পড়েছে।
ভানুগাছ রেলস্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের মাত্র ৫শ’ মিটারের মধ্যে পাতের সঙ্গে ৪১২টি ক্লিপ নেই। এ রকম হাজারও ক্লিপ চুরি হয়েছে কিন্তু দেখার কেউ নেই। ফলে ট্রেন চলাচলের সময় যে কোনো মুহূর্তে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে সিলেট বিভাগের ১৭৩ কিলোমিটার দেখভাল করার জন্য সরকারিভাবে ২৯ জন ওয়েম্যান নিয়োজিত আছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মাস শেষে নিয়োজিত ওয়েম্যানরা ঠিকই বেতন নিচ্ছেন। কিন্তু একজনই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
মৌলভীবাজার-আখাউড়ায় আন্তঃনগর, লোকাল ও মালবাহী মিলিয়ে প্রায় ১০-১২টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। রেল বিভাগের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দেশের অন্যতম পুরনো রেলপথ সিলেট-আখাউড়া। এখন অনেকটাই নড়বড়ে রেল সেতু ও লাইন। দ্রুত মেরামত কিংবা নির্মাণ না হলে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
সিলেট-আখাউড়া রেলপথের ১৭৩ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৫-৩০টি সেতু ও কালভার্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভানুগাছের গোপালনগর ও ফাজিলপুর এলাকার ৩০২/৭নং পিলার পর্যন্ত দু’ধারে প্রায় ৪১৬টি ক্লিপ-হুক নেই। দু’লাইনের জোড়া দেয়া স্থানেও ক্লিপ চুরি হয়ে গেছে।
দিনের পর দিন ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু ও ফিশপ্লেট চুরি হয়ে যাওয়ায় সেকশনটি অধিকতর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। চুরি হওয়া এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না। দ্রুত রেলপথের কল, ক্লিপ ও নাট লাগানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সম্প্রতি সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে বেড়ে চলা দুর্ঘটনায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন এ অঞ্চলের যাত্রীরা। সিলেটবাসীর জোর দাবি, দ্রুত এই জরাজীর্ণ রেললাইনটির (সার্বিক) সংস্কার।
রেলপথ সিলেট বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আহসান জাবিদ বলেন, রেলপথের মেরামত ধারাবাহিক প্রসেস। এক বছর করলে যে শেষ হয়ে যাবে এমন না। তবে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ও হুক। পাথরবিহীন অধিকাংশ রেলপথ।
এ জংশনের সঙ্গে গৌরীপুর-চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঝারিয়া ও মোহনগঞ্জ চার রেলপথের মোহনা। গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনের ৪টি রেলপথে প্রতিদিন আন্তঃনগর, লোকাল, কমিউটার ও মেইল ট্রেনসহ ৩২ ট্রেন আসা-যাওয়া করে। স্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেন চলাচলের জন্য ৫টি পৃথক লাইন রয়েছে। কিন্তু ২টি রেললাইন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ৩টি রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে।
প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুধু ময়মনসিংহের গৌরীপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম সীমানায় ট্রেন চলাচলের ৪টি রেললাইনের এ অবস্থা। তবে স্থানীয়রা জানান, প্লাটফর্ম সীমানার বাইরেও রেললাইনের অনেক স্থানে পর্যাপ্ত পাথর ও ফিশপ্লেটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নাটবল্টু না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। ফলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। নয়তো কুলাউড়ার মতো এখানেও ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
গৌরীপুর রেলস্টেশন মাস্টার আবদুর রশিদ বলেন, রেললাইনের ফিশপ্লেটে ৪টি নাটবল্টু থাকে। ৩টি থাকলে ট্রেন চলাচল করতে বড় রকমের ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু ২টি থাকলে ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু এই সেক্টরটা আমার আওতাধীন নয়, এটা রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ দেখভাল করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৌরীপুর রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, রেলওয়ের এই ত্রুটিগুলো সংস্কার ও রেললাইন মেরামত করার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।