খবর ৭১ঃ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ইমতিয়াজ মোহাম্মদ অনলাইনে একটি আলমারি অর্ডার করেন। সাড়ে ছয় হাজার টাকা মূল্যের ওই আলমারি বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায় সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে। বিপত্তি বাধে যখন প্যাকেটটি খোলা হয়। কাঠের আলমারি অর্ডার করলেও তিনি যা পেয়েছেন, তা কাগজের তৈরি।
ইমতিয়াজের মতো প্রতারিত হওয়ার এমন গল্প আছে আরও অনেকের। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে অনলাইনে কেনাকাটা জীবনযাত্রা সহজ করছে ঠিকই, তবে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগও কম নয়। প্রতারকদের নিত্যনতুন ফাঁদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে পণ্য কিনে নানাভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ক্রেতারা দাবি করেন, তারা যে পণ্য অর্ডার করেন, অনেক সময়ই তার পরিবর্তে অন্য কিছু দেওয়া হয়। কেউ কেউ অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য কেনেন, ফলে এ ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। ‘ক্যাশ ইন ডেলিভারি’র ক্ষেত্রে আবার পণ্য ফেরত পাঠাতে হলে দিতে হয় মাশুল। ফলে সঠিক পণ্যও পান না ভোক্তারা, আবার সময়ের পাশাপাশি গচ্চা যায় টাকাও।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত- এ ছয় মাসে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে তিন হাজার ৭৮৭টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৫৬১টি অনলাইনে কেনাকাটার। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দিনে দিনে অনলাইন কেনাকাটা যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠছে প্রতারক চক্রও। নিজেদের স্বার্থেই গ্রাহকদের দরকার আরও সতর্ক হওয়া।
এ প্রসঙ্গে অনলাইন পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর সমকালকে বলেন, বড় পরিসরে কাজ করা ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের সঙ্গে কখনও প্রতারণা করে না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খুলে চালানো কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেন। আজকের ডিলসহ বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, সেটি পুরোপুরি রিপ্লেস করে দেওয়া হয়। চাইলে ক্রেতাকে টাকাও ফেরত দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন সময়ে প্রতারিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনলাইনে পণ্য বিক্রয়সেবা দেওয়ার নামে গ্রাহকদের অভিনব কৌশলে প্রতারণা করে যাচ্ছে একটি চক্র। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নামে পেজ খুলে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বিভিন্ন নামিদামি পণ্য অর্ডার নিয়ে তারা ওই পণ্য না পাঠিয়ে নিম্নমানের বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে। মোবাইলের পরিবর্তে সাবান পৌঁছে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
অনলাইন শপিংয়ের নামে প্রতারণার অভিযোগে গত কয়েক বছরে র্যাব-পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। তারা নির্দিষ্ট গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা না নিলেও অসংখ্য গ্রাহক তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে অনলাইনে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব জানায়, চক্রটি ২০১৩ সাল থেকে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। ইউনিক ফ্যাশন, রোজ ফ্যাশন বিডি, লাইফস্টাইল ডটকম, গ্রিনএক্সপ্রেস ডটকম, জেন্টেল ফ্যাশন, জেন্টেল পয়েন্ট, ফ্যাশন পয়েন্ট, প্লাস পয়েন্ট, মোবাইল শপ টোয়েন্টিফোর, গয়না মহল, আরিফুল ইসলাম আরিয়ান, নিলয় মাহমুদ সুজন, এমডি তানভীর আবু তাহের, অ্যাডভান্স ইলেকট্রনি, ড্রিম ফ্যাশন ও জিয়ান রাইহান নামে এমন ১৭টি পেজ খুলে অনলাইনে পণ্য বিক্রির নামে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করত বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির একটি দৈনিককে বলেন, চক্রটি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের অনলাইনে দেওয়া পণ্যসামগ্রীর ছবি ডাউনলোড করে নিজেদের পণ্য হিসেবে চালিয়ে ফেসবুক পেজে আপলোড করত। সেসব পণ্যের নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দাম দেখে কেউ আকৃষ্ট হয়ে যোগাযোগ করলে চক্রটি প্রথমে সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করত। এরপর হোম ডেলিভারির মাধ্যমে নিম্নমানের পণ্য পাঠিয়ে দিত। নির্ধারিত মূল্যবান পণ্যের পরিবর্তে সাবান, ভিমবার, আলু, পেঁয়াজসহ নানা কিছু প্যাকেট করে পাঠিয়ে দিত। কখনও কিছু না পাঠিয়েই অর্থ আদায় করে পণ্য পাঠিয়েছে বলে দাবি করত চক্রটি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতারিত হলে কেনাকাটার প্রমাণপত্রসহ অভিযোগ করতে হবে। তবে সবার আগে যে কোনো কেনাকাটায় ক্রেতাকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে অনলাইন কেনাকাটায় বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করতে হবে।