খবর ৭১: তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ এক পয়সা না বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও গত তিন মাসে বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
এছাড়া দীর্ঘদিন খেলাপি থাকায় অবলোপন করা রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটিসহ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এদিকে গত বছরের মার্চের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা।
গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। খাতওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। তাদের বিতরণ করা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার .২৫৬ কোটি টাকা। এই খাতের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকারি দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে যেসব দুর্নীতি হয়েছে, তার একটিরও বিচার হয়নি; বরং তাদের রক্ষায় নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ কমাতে যে নীতিমালা করা হয়েছে, এসবই ভুল। এতে ভুল বার্তা (রং সিগন্যাল) দেওয়া হয়েছে। সে কারণে কেউ টাকা দিচ্ছে না। ধীরে ধীরে এটি আরও খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। সুশাসনের ঘাটতি, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগি এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা-এসব কারণে খেলাপি ঋণ না কমে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে গত বছর ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমিয়ে এনেছিল ব্যাংকগুলো। গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ৫ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমে। তবে তিন মাস যেতে না যেতেই পুরনো চেহারায় ফিরেছে খেলাপি ঋণ। মার্চে এসে পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ নতুন ঋণও খেলাপি হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষ সুবিধায় ২০১৫ সালে পুনর্গঠন করা ঋণের বড় একটি অংশও এখন খেলাপি। সব মিলিয়ে মার্চ প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এসব বৈঠক থেকে বারবারই খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা আসে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারিও দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার হিড়িক পড়ে। খেলাপিদের সুযোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলারও জারি করে। প্রথমে অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হয়। এর পর আন্তর্জাতিক মানের খেলাপি নীতিমালার পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গণছাড় দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। অনাদায়ী সুদ মওকুফ করে মাত্র ২ শতাংশ হারে ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য ওই সার্কুলারটি বর্তমানে উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। ৬-৭ বছর ধরে ঋণ খেলাপিদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ছাড় সুবিধায় নিয়মিত করা হয়েছে। এর পর খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা হিসাবের বাইরে রাখতে অবলোপন করা হয়েছে। এ ছাড়া আদালতে রিটে আটকে রয়েছে আরও প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ে তৎপরতা কম থাকে। ফলে এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। তাই বাস্তবতার নিরিখে নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে আদায় কার্যক্রম জোরদার না করলে খেলাপি ঋণের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা কঠিন হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ অবলোপন, এসএমএ ও অন্যান্যসহ প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হতে পারে। খেলাপি ঋণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে পূর্বঘোষণাই মূল কারণ। খেলাপিদের সুবিধা আসছে-চলতি বছরের শুরুর দিকে এমন ঘোষণায় অনেক নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীও বিরতি দেন। অনিয়মিতরা নিশ্চিত হয়েছেন যে তারা টাকা পরিশোধ না করলে কোনো ক্ষতি নেই। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেল।
ব্যাংকাররা জানান, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।