খবর৭১ঃ
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সেকালে যখন লিখতাম তখন লেখালেখি ছিল খেলার ছলে। লিখতাম এখানে-সেখানে। সেকালের দু’চারটে মাঝারি মানের সাপ্তাহিকীতে মাঝে-সাঝেই আসতো লেখা। বেড়ে গিয়েছিল তাই লেখালেখির সাহসও। নাই কম্পিউটার, নাই ইন্টারনেটের সেকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়তে যাওয়ায় লেখালেখির দীর্ঘ যবনিকাপাত। মাঝে অবশ্য দু’টো অনুবাদ গ্রন্থের সুবাদে সেকালেই বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য হয়ে লেখক হিসেবে নিজের দাবিটা পাকাপোক্ত করে রেখেছিলাম।
একালে আবারো লেখালেখির আরম্ভটা সহসাই, প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের উৎসাহে, কিন্তু তার অকাল প্রয়াণের পর। একালে অবশ্য লেখালেখির অন্য একটা তাগিদও আছে। হাসপাতাল আর চেম্বারে বসেই কাটে প্রতিদিনের জন্য বরাদ্দ চব্বিশের অনেকগুলো ঘন্টাই। রোগীরা শুধু আমাদের সংসারই চালান না, দেশের নানা প্রান্তের হরেক রোগীর সাথে নিত্য উঠা-বসার সুবাদে মাথায়ও ঘুরতে থাকে অনেক কিছুই। দেখি আশে-পাশের এটা-সেটা। আর সেসব নিয়েই চলতে থাকে আমার এলেবেলে লেখালেখি।
আমার জন্ম ’৭১-এর ঠিক আগে আগে। জন্মেই দেখেছি জ্বলতে স্বদেশ। স্বাধীন দেশে আমার বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তবে যতটা না চাকুরির পোস্টিং-এর সুবাদে, তার চেয়ে ঢেড় বেশি বাবার চাকরি সংক্রান্ত সাময়িক সামরিক জটিলতার জের ধরে আমার বেড়ে ওঠা এই ঢাকার বুকেই। জেনারেল এরশাদ সাহেবের মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে চাকুরিতে পুনর্বহালের পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি চাকরি করেছেন ঢাকার বাইরে-বাইরে। আর সেসময়টায় আমার বিদ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থাৎ ঢাকা কলেজ আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমার আর কখনোই তার সাথে তার কর্মস্থলগুলোয় থাকা হয়ে ওঠেনি। কাজেই আমার জন্য ঈদ বরাবরই ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক।
লেখালেখির মশলা যখন হাতড়ে ফিরছি, কি লিখব আর লিখব না- এসব চিন্তায় যখন কুঞ্চিত গণ্ডদেশ, তখন সহসাই মনে হল সেকাল আর একালের ঢাকাই ঈদ নিয়েতো লেখা চলতেই পারে। কিন্তু বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তিটাতো বিশাল। তাহলে লিখব কোন আঙ্গিকে?
লেখক হিসেবে আমার মান যা খুশি তাই হোক না কেন, অল্প-স্বল্প কিছু স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখালেখি বাদ দিলে আমার লেখাতো মূলতঃ সমসাময়িক সমাজ আর রাজনীতি নিয়েই। লিখতে বসার পরের অভিজ্ঞতাটা অবশ্য অন্যরকম। অবাক হয়ে দেখলাম মোটা দাগে সেকালের সাথে একালের ঢাকার ঈদ কেন্দ্রিক রাজনীতির ফারাক যোজনের পর যোজনের হলেও কিছু-কিছু জায়গায় তার পীড়াদায়ক মিল।
রাজনীতিতে ঈদ মানেই নেতার কাছে ধরনা দেয়া, চাই পাঞ্জাবিটা, সাথে সালামিটা। নেতা গলদঘর্ম সালামি আর পাঞ্জাবির সাপ্লাই চেইন ধরে রাখতে গিয়ে। সেকালে যেমন এটা একালেও ঠিক তেমনই। তবে একালের ঢাকায় ঈদ কেন্দ্রিক রাজনীতি বাড়তি অনুষঙ্গ ম্যারাথন ইফতার মাহফিল। মূল সংগঠন, অঙ্গ-সংগঠন, সহযোগী সংগঠন, ভাতৃপ্রতিম সংগঠন, আদর্শিক সংগঠন – সংগঠনের ক্ল্যাসিফিকেশন তো আঙ্গুলে গুনে শেষ করা দায়!
কাজেই সংগঠনের সংখ্যা যে কত হতে পারে তাতো সহজেই বোধগম্য। তার উপরে আছে সংগঠনগুলোর উত্তর, দক্ষিণ, থানা, ওয়ার্ড আর পারলে মহল্লা ইউনিটও। আর ইফতারের আয়োজন থাকবে প্রায় প্রত্যেকেরই। অতএব বুঝুন নেতার বিড়ম্বনা। আর নেতা যদিওবা সামাল দেন, ভাবুন একবার কি স্টিমরোলারটাই না চলে নেতার ডোনারদের উপর দিয়ে।
ঈদের দিন রাজনীতির মানুষগুলোর অন্যতম বিনোদন নেতার বাসায় ধরনা দেয়া। হাসিমুখে হাজারো কর্মীর কাছে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় নেতার ঈদের শিডিউলের অন্যতম অনুষঙ্গ। ভেতরে-ভেতরে কি চলে জানিনা, হাসিমুখে নেতা কিন্তু বিনোদিত করে চলেন তার ভক্তকুলকে। কিছু-কিছু নেতা আছেন যারা আবার এই সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে গোটা জাতিকে বিনোদিত করার দায়িত্বও নেন। যেমন সেকালে গাইতেন বি. চৌধুরী আর ব্যারিস্টার হুদারা আর একালে নাচেন পাপিয়ারা।
ঢাকায় ঈদের রাজনৈতিক চরিত্র আমার দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক পরিবর্তিত হতে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু তার মূল রসায়নটা কোথায় যেন একদমই একরকম রয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, মেট্রোরেল আর ফ্লাইওভারের এইকাল ঢাকাতো ঢাকা, পুরো দেশেরই খোলনালচে বদলে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অন্ততঃ কারো কারো কাছে শুধু ঈদ কেন বরং বছরের বারো মাসেরই রাজনীতি যে ভাগাড়ে ছিল সেই ভাগাড়েই পড়ে আছে।
’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর তথ্য সন্ত্রাস আর ইতিহাসের দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে যারা এদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছে তারা কিন্তু এখনো সেই জায়গাটাতেই আছে। ২০০৯-এর পর থেকে ড্যামেজ কন্ট্রোলের উদ্যোগ অনেক। অনেকটাই সফলও সেগুলো। কিন্তু পথ এখনো বাকি আরো অনেক বেশি। এই মাটির রোদে-জলে পুষ্ট হয়ে সেদিনের বাছারা যখন রাস্তায় নামে ‘আমি রাজাকার’ লেখা গেঞ্জি পরে, সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে তাদের স্ট্যাটাসে যখন দেখি শোকের বদলে হিন্দুর মৃত্যুতে স্বস্তিÍ আর রাস্তায় বিলবোর্ডে কিংবা টিভির পর্দায় যখন চোখে পড়ে ‘হিজাব ফ্রেশ’ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন তখন প্রতিবারই মনে হয়, রাস্তার শেষে আলোর দিশা আছে ঠিকই তবে তা এখনো বিন্দুসম। যেতে হবে এখনো বহুটা পথ।
যাহোক ঈদে ফেরত আসি। এবারের ঢাকার ঈদ বিনোদনে যোগ হয়েছে নতুন অনুষঙ্গ। ’৭৫ পরবর্তী বস্তাপচা রাজনীতির প্রবক্তারা যে আজ সংসদে-রাজপথে অস্তিত্বহীন তা সবার জন্য না হলেও, সরকারদলীয় কট্টর সমর্থকদের জন্য বিনোদনের বিষয় বৈকি। আমি অবশ্য সে প্রসঙ্গ টানছি না। ঈদ পূর্ববর্তী তাদের রাজনীতি যে বর্তমান গতি-প্রকৃতি এবং ঈদের পর আরো যেসব আলামতের আলামত ক্রমশঃই দৃশ্যমান তাতে কিন্তু আম জনগণের বিনোদনও কম হচ্ছে না।
সকালে সুষ্ঠু বলে বিকেলে বর্জন করা জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদকে কি তুলোধুনোটাই না করতে দেখেছি এই সেদিনও। সাংসদের মোয়ার লোভ সংবরণ করতে না পারায় এমনকি দল থেকে বহিষ্কৃত হতে দেখলাম সাংসদকে। অথচ সপ্তাহ না ঘুরতেই সেটাই ঠিক, বাকি সব বেঠিক। সিদ্ধান্তে এবাউট টার্ন, কিন্তু বড় নেতা চোয়ালের জোর কমেনি এতটুকুও। ক’দিন আগেই যত জোরে দিনকে রাত বলেছেন এখন তারচেয়েও বেশি তারস্বরে দিনকে দিন বলে জনগণকে ব্যাপক বিনোদিত করে ফেলেছেন।
জোট বেঁধে মানুষের মাথায় ‘ধান-সূর্যের’ জটলা পাকিয়ে যারা ঘোট পাকাচ্ছিলেন, পারলে সরকারকে গলায় আরেকটু হলেই ধাক্কাটা দিচ্ছিলেন আরকি, তারাও এখন জনগণকে এই ঈদেও আগে-পরে কম বিনোদন যোগাচ্ছেন না। পুচকে দলের পুচকি নেতা, একসময় যার ঝালে ধারে ঘেঁষা দায়, এখন কি অবলীলায়ই না স্বীকার করছেন রাজনীতিতে পাকতে তার নাকি ঢেড় বাকি। নিজের ভুল বুঝে তিনি এখন জোট বিমুখ। ব্যস্ত এখন জোটের জট ছিড়তে আর জনগণকে বিনোদিত করতে। আর রাজনীতিতে যিনি পেকে টসটস করছেন, বোধ হচ্ছে তারও। ঘোষণা দিয়েছেন ঈদের পর জোটের জট মুক্ত হবার।
‘জয় বাংলা, জয় ধানের শীষ’ শ্লোগানে জনগণকে শেষ বারের মত বিভ্রান্ত করতে যেয়ে এখন যারা সংসদের ভেতরে বাইরে জনগণের ঈদের আগে-পরে বিনোদনের খোড়াক হচ্ছেন, তারাই এখন আবার ঢাকার ঈদের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগাচ্ছেন। সেকালে তাদের দেখেছি সর্বগ্রাসী ভূমিকায় একালে তারা বিনোদনের ভাণ্ডার। আমার কেন যেন মনে হয় সেকাল আর একালের ঢাকায় ঈদের রাজনীতিতে এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য।