মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর (নীলফামারী)প্রতিনিধিঃ
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সকাল পৌণে নয়টা। নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দুই সারিতে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। টিকিট সংগ্রহ করতে আসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড় সামলাতে সৈয়দপুর রেলওয়ে থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য পোশাকে ও সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পোশাকে থাকা পুলিশদের নেতৃত্বে ছিলেন উপ-পরিদর্শক মো. ফেরাজুল ইসলাম। আর টিকিট কাউন্টারে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারি মো. মাহ্বুবুল হক মাহবুব। ঘড়ির কাটায় ঠিক নয়টা বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাউন্টার খুলে টিকিট দেওয়া দিতে প্রস্তুতি নেন তিনি (বুকিং সহকারি)। কিন্তু শুরুতেই ঘটে বিপত্তি। ইন্টারনেট সমস্যার কারণে কম্পিউটার কাজ করছিল না। ফলে টিকিটও দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় অপেক্ষার পালা। এরপর প্রায় ২০/২৫ মিনিট পরে টিকিট দেওয়া শুরু হয়। এর ঠিক ঘন্টাখানেক পরেই স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের বলা হয় চিলাহাটি থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের বরাদ্দকৃত সব টিকিটই শেষ। আর তখনই মানুষজনের মাঝে দেখা যায় হতাশার ছাপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার রেলপথে চলাচল করে বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন। এর বাইরেও যাতাযাত করে আরো অনেক কয়েকটি লোকাল ও মেইল ট্রেনও। উত্তর জনপদের জেলা নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করে আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গত ২৯ মে থেকে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দেওয়া হয় ৮ জুনের যাত্রার আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট। এর আগে গত বুধবার (২৯ মে) দুপুরের পর থেকে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের সামনে টিকিট নিতে আগ্রহী মানুষ অবস্থান নেন। বুধবার সারারাত কাটিয়ে পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলেনি একটি টিকিটও। আশায় থেকে অবশেষে টিকিট সংগ্রহ করতে না পেরে অনেকেই ফিরে যান ব্যর্থ মনোরথে। এ সময় তাদের চোখে মুখে ছিল চরম ক্ষোভ হতাশা। এমন একজন হলেন শহরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মোছা. লাইলী বেগম। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে এবারে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কোচিং করতে যাবে ঢাকা। তাই টিকিটের জন্য সেহরির পর থেকে এসে স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছি। টিকিট সংগ্রহ করতে আসা মানুষের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল মধ্যভাগে। কিন্তু কয়েকজনকে টিকিট দেওয়ার পর কাউন্টার থেকে বলা হয় বরাদ্দকৃত আন্তঃনগর নীলসাগর ট্রেনের টিকিট শেষ।
টিকিট নিতে এসেছিলেন শহরের আল-ফারুক একাডেমির সিনিয়র শিক্ষক মো. আমিনুল ইমলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে কথা হলে তিনি জানান, মেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। ঈদের পর ঢাকায় যেতে হবে মেয়েকে। তাই মেয়ের জন্য একটি টিকিট করতে এসেছেন। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি একটি টিকিট মেলাতে পারেনি। অবশেষে অনেকটা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয় তাকে।
রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দপুর রেলওয়ের জন্য আন্তঃনগর নীলসাগর ট্রেনের শোভন চেয়ার ১৭৬টি, এসি স্নিগ্ধা ৮ টি এবং এসি বার্থ ৮টি সিটের বরাদ্দ রয়েছে। এ সবের মধ্যে আবার অর্ধেক টিকিট অলনাইনে রেলওয়ে সেবা অ্যাপে এবং বাকিটা রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টার থেকে বিক্রির নিয়ম রয়েছে। আর টিকিটের জন্য কাউন্টারের সামনে নারী ও পুরুষ লাইন থেকে চারজন পুরুষ মানুষকে দেওয়ার পর একজন নারীকে টিকিট দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৪টি টিকিট এক সাথে কিনতে পারবেন।
বুকিং সহকারি মাহবুবুল ইসলাম মাহবুব জানান, কাউন্টারে অনলাইনে কম্পিউটার থেকে একটি টিকিট বের করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৩০ সেকেন্ড। সেই হিসেবে এক ঘন্টার কিছু বেশি সময়ই বরাদ্দকৃত সব টিকিটই দেওয়া সম্ভব।
তবে স্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এবং অনেকের সঙ্গে কথা বলেন টাকা গেছে, সৈয়দপুর স্টেশনে ভিন্ন কায়দায় টিকিট কালোবাজারির ঘটনা ঘটছে। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, এখানে টিকিট কালোবাজারিচক্র বেশ শক্তিশালী। তারা টাকা দিয়ে কিছু লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর তাদের লোকজন মূলতঃ টিকিট কাউন্টারের লাইনের অগ্রভাগে অবস্থান নেয়। কালোবাজারি চক্র এভাবে আগেভাগেই বরাদ্দকৃত সব টিকিটই তাদের হাতে নেয়। সাধারণ মানুষরা তাদের কাছে কোন রকম পাত্তাই পায় না। ফলে সৈয়দপুরে ট্রেনের টিকিট যেন সোনার ইরণে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ার শ্রেণীর প্রতি ৪৫৫ টাকা। অথচ ঈদের আগে ওই শ্রেণীর প্রতি টিকিট কালোবাজারে এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ৫ শ টাকা, এসি চেয়ার স্নিগ্ধা শ্রেণীর ৮৭০ টাকার টিকিট দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
এ নিয়ে বৃহস্পতিবার সৈয়দপুর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার মো. শওকত আলীর সঙ্গে তাঁর অফিসে বসে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তিনি বলেন, প্রতি ঈদের এ স্টেশনে টিকিটের অনেক চাহিদা থাকে। বিশেষ করে আন্তঃ নগর নীলসাগর ট্রেনের টিকিটের চাহিতা সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু এ স্টেশনে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের আসন বরাদ্দ যাত্রী সাধারনের তুলনায় অনেক কম। ফলে যাত্রীদের চাহিদামতো টিকিট সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হয় না। এতে যাত্রীদের নানা রকম উচ্চবাক্য কথাবার্তা বলেন আমাদের। প্রতি ঈদের আগে নীলসাগর ট্রেনে দুই একটি অতিরিক্ত বগি সংযুক্ত করলেই অনেক যাত্রীর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তিনি বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনেক বার অবহিত বলেছেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কমার্শিয়াল অফিসার মো. আনোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে কয়েক দফা চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।