রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো চলতি বছরেই দৃশ্যমান হবে

0
577

খবর ৭১ঃ চলতি বছরই দৃশ্যমান হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো। এরপর বসবে যন্ত্রপাতি। পারমাণবিক বিদ্যুতে জ্বলবে ঘরের বাতি, ঘুরবে শিল্পের চাকা। নামমাত্র খরচে উৎপাদন হবে বিদ্যুৎ। পূরণ হবে বাঙালির ছয় দশকের স্বপ্ন। পাবনার রূপপুরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে দেশের বৃহত্তম ও প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে মাইলফলক নয়, এ প্রকল্পের কারণে নতুন বৈশ্বিক মর্যাদায় আসীন হবে বাংলাদেশ। নাম লেখাবে নিউক্লিয়ার ক্লাবে। ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বে পদার্পণের যে স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখছে, তা এর মধ্য দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এতে ঋণ হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, বাকিটা বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে আসবে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি খরচ কয়লার চেয়ে প্রায় তিন হাজার গুণ কম। এক গ্রাম ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকা, যা দিয়ে উৎপাদন হবে ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ। ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হবে ৩ পয়সারও কম। তবে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো ব্যয় বেশি হওয়ায় এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পেতে খরচ হবে ৪ থেকে ৫ টাকা। এর পরও রূপপুর হবে দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রকল্প। প্রকল্পটির পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ১২০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে ও সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৪ সালেই উৎপাদনে আসবে। এ প্রকল্পে পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক দিন-রাত কাজ করছেন। আরও তিন-চার হাজার শ্রমিক কিছুদিনের মধ্যে যোগ হবে। চলতি বছরই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো দৃশ্যমান হবে।

অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে তাল রেখে যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ যন্ত্রপাতি রাশিয়া থেকে আসা শুরু করবে। তারপর সেগুলো অবকাঠামোয় বসানো হবে। ইতিমধ্যে কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের জন্য পাঁচটি ২০ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন রয়েছে ১০টির বেশি বহুতল ভবন। অন্য কাজগুলোও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পটি দেশের সার্বিক অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক অবস্থা বদলে দেবে। বিশ্বের বুকে দেশের মর্যাদা বাড়াবে। এই কেন্দ্রের জন্য উন্নত দেশের মতো বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো তৈরি করতে হচ্ছে। সঞ্চালন গ্রিড যেন কখনো বিপর্যয়ে না পড়ে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করতে টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সাইবার সিকিউরিটি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি যে পথে আসবে সেখানে লাইটিং, সিগনালিং ও সিকিউরিটি সিস্টেম সর্বোচ্চ পর্যায়ের থাকতে হবে। এর সবগুলোই আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) শর্ত। ইতিমধ্যে প্রতিটি বিষয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে উন্নত বিশ্বে পদার্পণের পথে অনেকটা এগিয়ে যাব আমরা। নিউক্লিয়ার প্লান্টের ভারী মালামাল আনতে মোংলা থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির নৌরুট হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সারা দেশের রেল যোগাযোগে হারমোনাইজেশন করা হচ্ছে, যাতে যে কোনো বন্দর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত রেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আনা যায়।

শৌকত আকবর বলেন, প্রকল্পটি ঘিরে পাবনাকেন্দ্রিক দেশের পশ্চিমাঞ্চলে তৈরি হয়েছে শিল্পোন্নয়নের অফুরন্ত সম্ভাবনা। কারণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রূপপুরের বিদ্যুৎ আশপাশ এলাকায় দেওয়া হবে। এতে পাবনা অঞ্চলে অ্যাগ্রো ও কেমিক্যাল শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে ওই অঞ্চলে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরমাণু সম্পর্কিত বিভাগ খুলছে। এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান-২০১৬ অনুযায়ী, ২০৪১ সালে দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার পড়বে। শিল্পায়ন যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে চাহিদা আরও বাড়বে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ ও সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে পারমাণবিক কেন্দ্রের বিকল্প নেই। তরল জ্বালানিতে বেইজলোড প্লান্ট হয় না। বেইজলোড প্লান্ট সারা বছর ২৪ ঘণ্টা কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুতেই এটি সম্ভব। এ ছাড়া তেল বা গ্যাসভিত্তিক প্লান্টের লাইফটাইম ৩০ বছরের কম, উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। পারমাণবিক প্লান্টের লাইফটাইম ৬০ বছর। রক্ষণাবেক্ষণ করে আরও ২০ বছর বাড়ানো যায়। উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ শতাংশের ওপরে। ফলে ১২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র থেকে কোনো অবস্থায়ই ১১৫০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ আসবে না। ফলে এখান থেকে দীর্ঘদিন সাশ্রয়ী মূল্যে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ মিলবে। এর জ্বালানিও পরিবেশবান্ধব। এ কারণে ২০৪১ সালের মধ্যে আরও চারটি পারমাণবিক ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখান থেকে আসবে ৪৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

দুর্ঘটনা বা তেজস্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে শৌকত আকবর বলেন, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই বললে চলে। অধিক নিরাপত্তা-সংবলিত বিশ্বের সর্বশেষ নকশার (ভিভিইআর-১২০০) রিঅ্যাক্টর বসানো হচ্ছে। ঘণ্টায় ৪৫০ মাইল বেগে ৫.৭ টন ওজনের একটি বিমান এর ওপর আছড়ে পড়লেও কনটেইনমেন্টের কোনো ক্ষতি হবে না। ১২৫ মাইল বেগের শক্তিশালী টর্নেডো বা রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও এর ক্ষতি করতে পারবে না। এ ছাড়া কোনো পরিস্থিতিতেই রিঅ্যাক্টরের ৩০০ মিটারের বাইরে তেজস্ক্রিয়তা যাবে না। এর বাইরে সারা জীবন মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here