খবর৭১ঃ
আমি ক্রিকেট বোদ্ধা নই। এখন যখন বাংলাদেশের ক্রিকেট হিমালয়ের চূড়ায় তখন এই বিপিএলের জমানায় খেলার সময় আমার কাটে হাসপাতালে আর চেম্বারে পেশার তাগিদে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ মানেই ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আমার উচ্চকিত সবান্ধব উপস্থিতি। সারাদেশের সঙ্গে আমিও কেঁদেছি যেদিন বুলবুলের সেঞ্চুরিতেও ঠেকানো যায়নি কেনিয়ার কাছে বাংলাদেশের পরাজয়। ভেঙ্গেছিল সেবার বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। একইভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কেঁদেছি সেদিনও যেদিন শেষ বলে এই কেনিয়া বধেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টিকেট জুটেছে। ক্রিকেট শুধু গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলাই নয়, ক্রিকেট একই সঙ্গে জটিল আইনী মারপ্যাঁচের খেলাও বটে। আমার ধারণা ক্রিকেটের যিনি পরম বোদ্ধা তার পক্ষেও ক্রিকেটে কতভাবে আউট হওয়া যায় তা বলা সম্ভব নয়। তবে আমার যা যৎকিঞ্চিৎ ক্রিকেট জ্ঞান তাতে আমি অন্তত এতটুকু বুঝি যে, ক্রিকেটে যতভাবেই আউট হওয়া যাক না কেন, একসঙ্গে পুরো টিম আউট হওয়া সম্ভব নয়। অথচ সেই অসম্ভবটাই সম্ভব হতে বসেছিল এই সেদিন ক্রাইস্টচার্চে। মাত্র পাঁচ মিনিট আর পঞ্চাশ গজের ব্যবধানে বেঁচে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, বেঁচে গেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম বেঁচে গেলেও সেদিন অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে আরও অনেকের সঙ্গে নামাজ পড়তে যাওয়া অন্তত পাঁচজন বাংলাদেশী। ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ডের সরকার প্রধান বলেছেন ‘ওরা ওদের’। প্রায় দুইশত জাতিসত্তার বাস যে নিউজিল্যান্ডে সেই দেশটি গড়ে তোলায় আর প্রত্যেকের মতো হতভাগ্য ঐ পাঁচ বাংলাদেশীর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তাই এই হত্যাযজ্ঞ যেমন আমাদের মর্মাহত করেছে তেমনি তা কাঁপিয়ে দিয়েছে সাত সাগরের ওপারের নিউজিল্যান্ডকেও। অনেকে বলছেন এটি বর্ণবাদী হামলা। কারও কারও কাছে এটি ধর্মীয় উগ্রবাদের উন্মত্ত বহির্প্রকাশ।
নিউজিল্যান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই নেদারল্যান্ডসের ইউট্রিখটে ট্রামে বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে আরও তিনজন। এগুলো হচ্ছে মাত্র সাতদিনেরও কম সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের উন্নততম দুটি দেশে ঘটে যাওয়া দুটি দুর্ঘটনা, যা আলোড়িত করেছে গোটা পৃথিবীকে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীজুড়ে এই ফেনোমেনন দীর্ঘদিনের। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের মূল ভূ-খণ্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ফুলের টোকাটি লাগেনি, সেই মার্কিন মুল্লুকের হৃৎপি-ের কাছাকাছি নিউইয়র্ক শহরে সন্ত্রাসী হামলায় ঢলে পড়েছিল বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ জোড়া বিল্ডিং দুটি। মার্কিন মুল্লুক থেকে নিউজিল্যান্ড, লিবিয়া থেকে ভারতবর্ষ কোথায় ঘটেনি সন্ত্রাসী হামলা? বাদ যায়নি প্রিয় বাংলাদেশও। এক সময় পৃথিবীতে বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হতো সম্পদ আরোহণের তাগিদে উপনিবেশ বাড়াতে গিয়ে। আর আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধছে সন্ত্রাসের পটভূমিতে। এই তো সেদিনও ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে গিয়ে থেমে গেল তারও কারণ ঐ একটাই। সন্ত্রাস কেন? কে দায়ী? ধর্মীয় মৌলবাদ না আন্তর্জাতিক শোষণ, বর্ণবাদী উগ্রতা না অন্যকিছু- এসব আলোচনায় আমি যাব না। তার চেয়ে বড় কথা সে আলোচনায় যাওয়ার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন আমার তা সীমিত। আমার বরং লক্ষ্য বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে আজকের বাংলাদেশকে একজন বাঙালী হিসেবে আমি কিভাবে দেখি তাই দু’কলম তুলে ধরা।
বিশ্বের দেশে দেশে যখন সন্ত্রাসী হামলায় ভূমিকম্পের নাচন, আমি কিন্তু রাতে ঘুমাই পরম শান্তিতে। আমার দেশে সন্ত্রাসের আঁচড় যে ক্ষত তৈরি করেনি তাতো নয়। এখনও মনে আছে হলি আর্টিজানের সেই ঘটনার পর কি উৎকণ্ঠা নিয়েই না টিভি সেটের সামনে বসে ছিলাম সারাটা রাত। সফল সেনা অভিযানের পর যখন ঘুমাতে গেছি সূর্য তখন মাথার ওপরে। এরও আগে সারাদেশ যখন কেঁপেছে সিরিজ বোমা হামলায়, আদালতের কক্ষে বসে নিহত হয়েছেন বিজ্ঞ বিচারক কিংবা শুধু প্রাণের তাগিদে রমনার বটমূলে নতুন বছরটাকে বরণ করতে গিয়ে অসহায়ভাবে মারা গেছে সংস্কৃতিমনা বাঙালীরা, তখন আমার যে অনুভূতি তাতে আমি খুব ভালই বুঝি আজকের নিউজিল্যান্ড কিংবা নেদারল্যান্ডসের মানুষগুলোর উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। তারা যখন চোখে দেখছেন কখনও সর্ষে ফুল আর কখনওবা চারদিকে অন্ধকার, তখন আমার কৃতজ্ঞতা সরকারের কাছে আমার রাষ্ট্রটিকে অন্ধকার আর সর্ষে ফুলমুক্ত রাখার জন্য। পৃথিবীর আর কোন দেশ এভাবে সন্ত্রাসকে নির্মূল করতে পেরেছে কিনা জানি না, শুধু জানি আইএস কিংবা জইয়শ-ই-মোহাম্মদের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব যখন এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে পুষ্ট হচ্ছেন তখন আমার দেশে এটা-সেটা, নাম জানা আর অজানা যত মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব হয় আজ কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে বসে চোখের সামনে উড়ে বেড়ানো সর্ষে ফুলগুলো গুনছেন অথবা এমন কোথাও আছেন যেখানে এই পার্থিব চাওয়া-পাওয়া তাদের আর স্পর্শ করে না। আমি হলফ করে বলতে পারি, কেউ যদি পেরে থাকেন তবে পেরেছেন আমার মাননীয় সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা আরও একটি কারণে। তিনি শুধু সন্ত্রাসকে সমূলে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলেননি, বরং ’৭১, ১৫ আগস্ট, ৩ নবেম্বর আর সবশেষ ২১ আগস্টের অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে বাংলাদেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন অপরাধী যে-ই হোক আর যত আগেই অপরাধ করে থাকুক না কেন এই বাংলাদেশে একদিন না একদিন তার বিচার হবেই। তিনি নিশ্চিত করেছেন আমাদের রাতের নিশ্চিন্ত ঘুম, আমাদের সন্তানদের নির্বিঘ্ন বাসভূমি। আরও একবার ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে আর আপনাকে স্বাগতম ‘নিরাপদ বাংলাদেশে’।