উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: শাড়ি বুননের তাঁতের শব্দে এখন আর মুখরিত হয়না নড়াইলের তাঁতপল্লীগুলো। বস্ত্র দোকানের মালিক গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি বিক্রেতা বলেন, আগে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তাঁতের বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় করতেন ।বর্তমানে তাতের সেই পণ্য পাওয়া যায়না। ফলে কোম্পানির পণ্য বিক্রি করেন। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায় জানান, নড়াইল শিল্প সহায়ক কেন্দ্র বিসিকের উপ পরিচালক এসএম কামরুল হাসান বলেন, টেক্সটাইল, গার্মেন্টসগুলি অনেক কম দামে গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি বিক্রি করছে। ফলে তাঁতীরা মার খেয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ শিল্পের মারপ্যাচের কারণে কুটির শিল্প হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। পাশাপশি উপকরণের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সমস্যা উত্তরণে বিসিক কারিগরদের তালিকা প্রস্তুত, তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ প্রদান ও বাজার সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা থাকবে।নতুন গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি বুননের তাঁতের শব্দে এখন আর মুখরিত হয়না নড়াইলের তাঁতপল্লীগুলো। যেন নিঃশব্দ নিরবতা। জেলা সদরের আফরা, কলোড়া, আগদিয়া, মাইজপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিলো এক হাজার তাঁতী পরিবার। তাঁতের পণ্য উৎপাদন করে চলতো তাদের জীবন জীবিকা। বর্তমানে পণ্য বানানো উপকরণ সুতোর দাম বৃদ্ধি, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়া, ফ্যাক্টারিতে উৎপাদিত পণ্যের দাপট, সর্বোপরি সরকারের কোন সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে সব তাঁত। এই পেশায় জড়িতদের চোখে এখনো আশা সরকারের সহযোগিতা পেলে আবারো শুরু করবেন ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকাজ। জানাগেছে, মাত্র ১০,১২ বছর আগেও চালু ছিলো জেলার বেশ কিছু তাঁতপল্লী। বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে সব তাঁত, জীবন বাঁচাতে বাপ-দাদার পেশা বদল করে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কেউ দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ভানচালক, কৃষি পেশাসহ চলে গেছেন বিভিন্ন পেশায়। ঘরের নারীরাও তাঁতের পণ্য বানাতে পুরুষদের সহযোগিতা করতেন তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন। প্রতিটি বাড়িতে যে ঘরে তাঁতের পণ্য বানানো হতো সব উপকরণ খুলে ফেলে তাঁতের ঘরটি এখন অন্য কাজে ব্যবহার করছেন আফরা গ্রামের সোহেল গাজী সর্বশেষ চালু তাঁত থেকে একটি গামছা বানাচ্ছিলেন, মাঝপথে সমস্যা হওয়ায় তিনি মেরামতের চেষ্টা করছেন না। এই অবস্থাতে পড়ে আছে তিনমাস, এটির পরিসমাপ্তির মাধ্যমেই বন্ধ হবে এই গ্রামের সর্বশেষ তাঁতের অধ্যায়। গ্রাম সমুহে ঘুরে দেখা যায় এখন সুতো কাটার চরকা, বানাবার বিভিন্ন আনুসঙ্গ পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়। এই পেশায় জড়িতরা বলেন, আফরা গ্রামে ৮০/৯০ পরিবার তিন শতাধিক তাঁতের মাধ্যমে পণ্য তৈরি করতেন, পণ্য উৎপাদনের সুতোসহ উপকরণের দামবৃদ্ধি আর উৎপাদিত কাপড়ের দাম কম হওয়ায় লোকসানের কারণে এবং সরকারের কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় ধীরে ধীরে এই পেশা থেকে সরে অন্য কাজ করতে হচ্ছে। তবে সরকার যদি পুনরায় সহযোগিতা করে অনেকেই ফিরে আসবেন বাপ দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশায়। গাজী ফরিদুল বলেন, তিনি নিজের নামেই গামছা, লুঙ্গি তৈরি করে জেলা ও জেলার বাইরে বিক্রি করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বিকল্প পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া গ্রামে ৮০ ঘর কারিগর পরিবারের বসবাস। ২ শতাধিক তাঁতের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করতেন। এখন অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে সবাই পেশা বদল করেছেন। জীবিকার প্রয়োজনে পেশা বদল করে চলে গেছেন দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ভানচালক, কৃষিসহ বিভিন্ন পেশায়। এই সব পরিবারের নারী সদস্যরাও পুরুষের সঙ্গে কাজ করে উৎপাদন করতেন তাঁতের বিভিন্ন পণ্য, আনতেন সংসারে স্বচ্ছলতা, সন্তানদের লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কাজে দিতেন সহযোগিতা। কিন্তু সুতোসহ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে পণ্য উৎপাদন। সংসারের প্রয়োজনে অনেক নারী এখন মাঠে কাজ করে, বাসাবাড়িতে বা ফ্যাক্টারিতে কাজ করে সংসার চালাতে পরিবারের পুরুষ সদস্যকে সহযোগিতা করছেন। তবে, তাঁতের কাজ ভাল ছিলো, ঘরে বসে করা যেত কিন্তু এখন রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কৃষি কাজ করতে হচ্ছে। সরকার সহযোগিতা করলে পুনরায় তাঁত চালু করা সম্ভব হবে। কারিগর সম্প্রদায়ের সন্তানেরা কেন এই পেশায় জড়িত হচ্ছেন না এই প্রসঙ্গে তারা বলেন, গার্মেন্টেসের কাপড়, বিদেশি কাপড়, ফ্যাক্টরির কাপড়ের দাম কম হওয়ায় এবং তাতের লুঙ্গি, গামছা, শাড়িরসহ উৎপাদিত পণ্য সেই হিসেবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় তারা এই পেশা থেকে সরে এসেছেন। পাশাপাশি এই পেশায় জড়িতদের সমাজে ঘৃণিত চোখে দেখা হয়, যারা এই ঐতিহ্যবাহী পেশা তথা কৃষ্টি সংস্কৃতি ধরে রেখেছে তাদের কেন অবহেলার চোখে দেখা হবে আক্ষেপের সঙ্গে বলেন।
খবর ৭১/ইঃ