ভাঙ্গনে আয়তন হারাচ্ছে সুন্দরবন

0
792

হেদায়েত হোসাইন,বাগেরহাট :
পৃথিবীর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ ক্ষ্যাত সুন্দরবনে বনের আয়তন কমেই চলেছে। উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমার ফলে তিব্র লবণাক্ততা, ভাঙন ও ভূমিদস্যুর কবলে পড়ে গত ৩৭ বছরে সুন্দরবনের ১৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন হারিয়েছে সুন্দরবনের। আর সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী কয়েক কিলোমিটার জুড়ো ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’র (ইসিএ) বনভূমির কি পরিমান ক্ষতির মুখে পড়েছে তার কোন হিসেব নেই। পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, দেশের ৫১ ভাগ বণাঞ্চালের এই সুন্দরবন জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করছে। এর ফলে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শর্ত অনুযায়ী সুন্দরবনের তি হতে পারে, এমন কোনও তৎপরতা চালাতে পারে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) ‘টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস অব কোস্টাল ইরোশন ইন দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ম্যানগ্রোভের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী যতটুকু নতুন করে বন গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে ভেঙেছে বেশি। এই ৩৭ বছরে নতুন ভাবে চর জেগেছে মাত্র ১০৪ বর্গকিলোমিটার, আর ভাঙনের কারনে সুন্দরবন তার আয়তন হারিয়েছে ২৩৩ বর্গকিলোমিটার। আবার ভাঙার হার পূর্ব দিকের চেয়ে পশ্চিম দিকে অনেক বেশি।
স্পারসোর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে বন কমেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বেড়েছে ২৯ বর্গকিলোমিটার হারে। আবার একই সময়ে হারিয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সময়কালে সুন্দরবনের আয়তন বেড়েছে বছরে মাত্র ৬ বর্গকিলোমিটার হারে। এ সময়ে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়েছে ৪২ বর্গকিলোমিটার সুন্দরবন। শুধু মাত্র ভাঙনের কারণেই প্রতিবছর ৬ বর্গকিলোমিটার করে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। ১৯৭৩ সালের পর মাত্র ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। গবেষকদের ধারণা, উজানের পানি কম আসার কারনে নদীগুলোর ক্ষীণ প্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে ভাঙা-গড়ার ব্যবধান বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাব রয়েছে। ভাঙা-গড়ার এই প্রবণতা স্থায়ী হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বনটির বাংলাদেশ অংশ আরো সংকুচিত হবার আশংকা বেড়েই চলেছে।
সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন। যা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের বাংলাদেশে অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাঙাগড়ার মধ্যে আয়তনে ছোট হয়ে আসার পাশাপাশি সুন্দরবনের আশেপাশে নানা শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ভূমি অধিগ্রহণ ও মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে এই বনটি তার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর এই এলাকাতেই শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। যদিও তাদের দাবী বনের নিদ্দিষ্ট দুরত্বে এসকল ছাড় পত্র দেয়া হয়েছে । ইতোমধ্যে আয়তন কমার পাশাপাশি কমেছে গাছ ও প্রাণি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মতে, ১৯৫৯ সালে এই সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে সুন্দরী গাছের সংখ্যা ছিল ২১১টি। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬ এ নেমে এসেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা নেমে আসতে পারে ৮০টিতে। ফারাক্কা বাধেঁর কারনে মূলত উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়া ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারনে সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এর কারনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে বা প্রাণপ্রকৃতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক মোহম্মদ ফিরোজ জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সামনে আর কোনও পথ নেই। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাতে হলে ওয়ার্ড হ্যারিটেজ এই সুন্দরবনকে ম্যনগ্রোভ বনের মতো করেই ¯^ভাবিক নিয়মে থাকতে দিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবনের কোলঘেঁষে কোনও ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপন করলে, এর বর্জ্য, ধোঁয়া যে বনের ভয়াবহ তি করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।কারণ সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম একদমই অনন্য।’এছাড়া সুন্রবনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারনে সুন্দরবনে গাছপালা , বন্যপ্রানী জলজ প্রানীসহ কয়েশ শত প্রজাতির মাছ সংকটে পড়েছে । মংলা বন্দরসহ কলকারখানার বর্জ নদী অববাহিকায় দীর্ঘ্য মেয়াদী প্রভাব ফেলবে । যা খালি চোখে দৃশ্যমান নাও হতেপারে । পানিতে থাকা মাছসহ অনেক প্রানী খাপ খাওয়াতে পারবেনা । সেই সকল প্রানীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাবে । একটা সময়ে ঐ প্রজাতিটি হারিয়েযাবে । অনেক প্রানী এই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে স্থান পরিবর্তন করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে ।

সেভদ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড: শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন সুন্দরবন আমাদের শুধু মাত্র সম্পদ নয় এটি আমাদের গর্ব । বিশ্ব ঐতিহ্য এ বনকে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে । বিশেষ করে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শর্ত অনুযায়ী সুন্দরবনের তি হতে পারে, এমন কোনও তৎপরতা চালাতে পারবেনা বাংলাদেশ । সেই শর্তের ব্যাপারে সরকারের উদাসিনতা লক্ষ্যকরা যাচ্ছে ।

বনসংরক্ষক ও বন্যপ্রানী ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগের বন সংরক্ষক মো: জাহিদুল কবির মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকে বলেন , জলবায়ুর প্রভাবেই প্রতিবছর বন যে পরিমান কমছে সেই পরিমান গড়ছেনা । গভীর সমুদ্রের ঢেউয়ের কারনে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে ভাংগনের মাত্রা অনেক বেশী । একারনে প্রতি বছর কিছু বন ভ’মি কমছে ইতো । এছাড়া সুন্দরবনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন ধরনের শিল্প কলকারখানা থাকলে তার প্রভাব অবশ্যই বনের উপর পড়বে । #

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here