খবর ৭১ঃরোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।
তিনি বলেন, এটি একটি ‘মানবিক ট্র্যাজেডি’। এমন পরিস্থিতি যারা তৈরি করেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।
দু’দিনের ঢাকা সফরের প্রথম দিন রোববার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের দেশ ও জাতির জন্য একটি জটিল সমস্যা। আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা। সম্মানজনক অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কাছে রাখাইনে একটি ‘সেফ জোন’ সৃষ্টি করার প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এসব জানানো হয়।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সকাল পৌনে ৯টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব অফিস কক্ষে বৈঠক শুরু হয়। নিরাপত্তার কারণে মিডিয়া কর্মীরাও সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন জিম ইয়ং কিম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) সংক্রান্ত বৈঠকে অংশ নেন তিনি।
এরপর তিনি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি হলিক্রস গার্লস স্কুল পরিদর্শন করেন। আজ তিনি কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে সকালে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর একটি যৌথ ভিডিও বার্তা প্রকাশ করা হয়। সেখানে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, বাংলাদেশ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একটা সহায়তা তহবিল গঠনের কাজ করছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এর অংশ হিসেবে আজ জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বব্যাংক ৪৮ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছি। এর পুরোটাই অনুদান। যদিও এ সহায়তা অতি সামান্য। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য সবার কাজ করা প্রয়োজন। আমি আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশের মানুষ এতসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ধারণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, একক দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক এবার বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সহায়তা দিচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশকে ৩০০ কোটি ডলার (প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেবে।
বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, এমন একটা সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বব্যাংককে পাশে পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট। রোহিঙ্গাদের মতো এতবড় বোঝা বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশ কখনও তা করত না। আমরা তাদের নিজ দেশে যথাযথ মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরত পাঠাতে চাই। এজন্য আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শরণাপন্ন হয়েছি। কারণ এটা আমাদের জন্য অনেক বড় বোঝা। এরই অংশ হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে কাছে পেয়েছি।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে দুপুরে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের মহাসচিব মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুতে এসেছেন। ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে ১০ লাখ গৃহহারা রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব একাই পালন করছে বাংলাদেশ। শীর্ষ দুই আন্তর্জাতিক সংস্থার দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বাংলাদেশে আগমনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় সচেতন এটি প্রমাণ হয়। এতে মিয়ানমারের ওপরও কিছু চাপ সৃষ্টি হবে। রোহিঙ্গাদের সম্মান ও নিরাপত্তা এবং ভবিষৎ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বড় ধরনের দায় রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘সেফ জোন’ সৃষ্টি করতে হবে। এ প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের মহাসচিবকে দিয়েছি। এজন্য যেসব উপকরণ দরকার সেটি একমাত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দিতে পারবে। আর এ জোনের নিরাপত্তা দেবে বার্মিজরা। একটি ইমারজেন্সি বাহিনী গঠন করে সেখানে পাঠাতে হবে। তাহলে এর দ্রুত সমাধান পাওয়া যাবে। অন্যথায় হবে না।
মিয়ানমারের ওপর বিশ্বব্যাংক কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে কিনা প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের রিলিফ প্রকল্প বাদে অন্য সব ধরনের প্রকল্প অনুমোদন বন্ধ করে দিয়েছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গাদের সহায়তার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক অনেক আগ থেকেই সোচ্চার। ইতিপূর্বে ওয়াশিংটনে এ নিয়ে সংস্থাটি বৈঠক করেছে। সেখানে ৫০ কোটি ডলার সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ৪৮ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ৫ কোটি মার্কিন ডলার যে কোনো দিন দেবে। যেহেতু এ সহায়তার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি হয়নি। চুক্তির আগে এ অর্থ দেবে। বাকি অর্থ আগামী ২ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে দেবে।
এ ধরনের সহায়তা দেয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন এদেশে থেকে যাচ্ছে এমন কোনো বার্তা পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রথমে আমরা ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। এখনও কোনো সুরাহা হয়নি।
মিয়ানমারের নেতাদের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক কিনা এ ধরনের আবোলতাবোল বলছেন। অল আর রাবিশ। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা সদস্য দেশগুলোর কাছে জাতিসংঘ চেয়েছে এ প্রসঙ্গে রোববারের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতিসংঘের মহাসচিব কিছু বলেছেন কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ প্রসঙ্গে কোনো কথা হয়নি।
মিয়ানমার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটি মিলিটারি জান্তার মাধ্যমে একটি দেশ দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পেশিত হচ্ছে। এটি দুঃখজনক। মিয়ানমার সম্পদের দিক থেকে ধনী হলেও মানুষগুলো খুব গরিব। খাবারও ঠিকমতো পায় না।
তিনি বলেন, এত রোহিঙ্গা আমরা রাখতে পারব না। তাদের সাময়িক আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এ আশ্রয় খুব ব্যয়বহুল। তাদের পেছনে যে ব্যয় হচ্ছে আগামী এক বছরে হয়তো আমাদের সমস্যা হবে না। এক বছর ধরে আমরা তাদের লালনপালন করছি। এটিও হয়েছে বিশ্ব সাহায্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বাজেট থেকে খুব বেশি ব্যয় হয়নি। আগামী বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছে। আশা করছি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আগমনে আমাদের পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে যেত। বিশ্ব সম্প্রদায় সহায়তা করার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি রক্ষা করছে।
খবর৭১/ইঃ