উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:নড়াইলে ছয় মাসের ব্যবধানে দুই ইউপি চেয়ারম্যানকে খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নড়াইলের কালিয়ার এক ইউপি চেয়ারম্যানকে নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় ও নড়াইলের লোহাগড়ায় অপর এক ইউপি চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। উভয়েই রাজনৈতিক হত্যার শিকার। এঁরা দুজই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দুটি খুনের কারণ অজ্ঞাত মনে হলেও নিজেদের দলীয় কোন্দলেই খুন হয়েছেন তাঁরা। নিহত ব্যক্তিরা ইউনিয়ন পরিষদের জন প্রতিনিধি ছাড়াও সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তাঁরা খুন হওয়ার পর স্বজনদের মামলার ভিত্তিতে অভিযুক্ত খুনিদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করা হয়েছে। একেরপর এক ইউপি চেয়ারম্যান খুনের ঘটনায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন। জনমনেও আতংক বিরাজ করছে। জানা যায়, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নাহিদ হোসেন মোল্যাকে গত বছর ২৫ আগস্ট ভোরে সীমান্তবর্তী খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজিরহাটের নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও এলাকাবাসীর ধারণা, স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দল ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও গত ২০০৯ সালে ইউপি নির্বাচনের দুই বছর আগে নাহিদ মোল্যা আ’লীগে যোগ দেন। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এরপরও বিপুল ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। স্থানীয়রা জানান, জেলা আ’লীগ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের দুটি গ্রæপে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছে। এর আগেও দুই গ্রæপের সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। নিহত চেয়ারম্যান নাহিদ মোল্যা পিরোলি, পুরুলিয়া, হামিদপুরসহ আশপাশের ইউনিয়নের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রভাব বিস্তারের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা তাদের।আরো জানা যায়,নাহিদ মেল্যাার পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরেই ওই এলাকায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাবা আবদুল হামিদ মোল্যা একই ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তার বাবাকেও গুলি করে হত্যা করে। বাবার মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হন তার ভাই আকবর মোল্যা। তিনিও দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলেন। ভাইয়ের পর নাহিদ হোসেন মোল্যা চেয়ারম্যান হন। নাহিদ হত্যার পর তাঁর স্ত্রী পলি বেগম আ’লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। হামিদপুর ইউনিয়নটি চেয়ারম্যান নাহিদের বাবা আবদুল হামিদের নামেই নামকরণ করা। এ ঘটনায় হামিদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদকে প্রধান আসামী করে ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৭ জনকে আসামি করে নিহতের স্ত্রী পলি খানম বাদী হয়ে দিঘলিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন (মামলা নং-১১, তাং-২৬/৮/১৭)। একইভাবে, গত ১৫ ফেব্রæয়ারি দুপুর পৌনে ১২টার দিকে লোহাগড়া উপজেলা নির্বাচন অফিস এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেল আরোহী উপজেলার দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান পলাশকে প্রথমে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান পলাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ১৭ ফেব্রæয়ারী রাত পৌনে ১২টার দিকে লোহাগড়া থানায় দায়েরকৃত মামলায় নড়াইল জেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কুমড়ি গ্রামের বাসিন্দা শরীফ মনিরুজ্জামান, দিঘলিয়া ইউপি নির্বাচনে পরাজিত আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাছুদুজ্জামান মাসুদ, সাবেক দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইমতিয়াজ আহম্মেদ মাসুম, দিঘলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ওহিদুর রহমান সরদার, আ’লীগ নেতা শেখ বনিরুল ইসলাম বনিসহ ১৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর ঢাকা থেকে শরীফ মনিরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও দলের অন্তঃকোন্দলের জের ধরে উপজেলার দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতা লতিফুর রহমান পলাশ খুন হয়েছেন বলে ধারণা করছেন তাঁর পরিবার ও সাধারণ মানুষসহ দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তিনি ২০১০ সালের দিকে বিএনপি থেকে আ’লীগের রাজনীতি যোগদান করেন। স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের মেরুকরণে দ্বিধাবিভক্ত আ’লীগ। যে কারণে দলীয় কোন্দল, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ ও মাদক, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়াটা হত্যাকান্ডের সম্ভাব্য কারণ বলে মনে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে হত্যাকান্ডের তদন্ত চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছেন। রাজনৈতিক ও স্থানীয় বিরোধই এ দু’টি হত্যাকান্ডের মূল কারণ হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পুলিশের মাঠে কাজ করছে। এ মামলা দু’টির তদন্ত চলছে। এদিকে, মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এ দু’জন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হত্যাকান্ডের ঘটনায় জেলার অন্যান্য ইউপি চেয়ারম্যানরাও আতংকের মধ্যে রয়েছেন। তারা স্বাভাবিকভাবে একাকি চলা-ফেরা করতে সাহস পাচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে কালিয়া উপজেলার চাঁচুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হিরক,আমাদের জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়কে জানান, বলেন, প্রকাশ্যে দিবালোকে প্রশাসনের নাকের ডগার ওপর একজন জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিরল ও উদ্বেগজনক। গত ২৮ ডিসেম্বের হামিদপুর ইউপি উপ-নির্বাচন চলাকালে গাজীর হাট যাওয়ার প্রাক্কালে আমার ও পুরুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মনির ওপর হামলা হলেও পুলিশ রহস্যজনক কারণে থানায় মামলা নেয়নি। যে কারণে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানদের নৃসংশভাবে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস দেখিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। সন্ধ্যার পর এমনকি দিনেরও বেলায়ও আমরা ঘর হতে বেরোতে সাহস পাচ্ছি না। আমাদের পরিবরা ও স্বজনরাও উৎকন্ঠিত।’একই প্রসঙ্গে নড়াইল সদরের কলোড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্বাস সরদার, আমাদের জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়কে জানান, একের পর এক ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে হত্যার ঘটনায় মনে হচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা এখন টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। যে কারণে আমরা অজানা আতংকে ভূগছি। আমাদের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া জরুরী।’
খবর৭১/এস: