প্রতি বছরই টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ছে

0
367

খবর৭১: বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে করা বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে দেশ থেকে টাকা পাচারের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে ১৫০ কোটি থেকে ৫৫০ কোটি ডলার। দেশে আইনের শাসন না থাকা, বিনিয়োগে দারুণ মন্দা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অর্থপাচার বাড়ছে বলে মনে করেন শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। এর সঙ্গে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীরাও জড়িত বলে মনে করেন তারা।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ থেকে গত চার দশকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৮০ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা এটাও বলছেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা উপায়ে অর্থপাচার বেড়েছে। তাদের ভাষ্য, অর্থপাচার যে হচ্ছে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াই তার প্রমাণ। বিশ্ববাজারে এখন ডলারের দাম কমতির দিকে। কিন্তু বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। তারা বলছেন, নির্বাচনের বছরে এমনটি হয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্ববাজারে যখন ডলারের পতন হচ্ছে, ঠিক ওই সময় বাংলাদেশের বাজারে ডলারের দাম বাড়ছে। এর পেছনে বড় কোনো দুর্বলতা আছে। আমদানির আড়ালে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। নির্বাচনের বছরে এমনটি হয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচনের বছরে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার বেড়ে যাওয়ার কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে চলেছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থ। অনেকে ভুয়া এলসি (ঋণপত্র) অথবা ওভার ইন-ভয়েসের মাধ্যমেও অর্থপাচার করছেন বিভিন্ন দেশে।’

আর্থিক খাতেরর বিশ্লেষকরা বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়। যেসব মাধ্যম ও পথ ব্যবহার করে বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে, এবার সেসব পথ বন্ধ করতে উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থপাচারের মাধ্যমগুলো শনাক্ত ও বন্ধ করার পাশাপাশি এ চুক্তির লক্ষ্য হলো আমদানি-রফতানির আড়ালে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও কাজ শুরু করেছেন। তবে অর্থনীতিবিদরা বলেন, নানান কড়াকড়ির পরও প্রত্যেক নির্বাচনী বছরেই অর্থপাচার বেড়ে যায়।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে সাতশ কোটি ডলারেরও বেশি। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ ঘাটতি এক হাজার ৩শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও বড় ঘাটতির আশঙ্কা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৪৩৪ কোটি ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি বাড়ছে। তবে খতিয়ে দেখা দরকার, আসলে বিনিয়োগের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না কি অর্থ পাচার হচ্ছে।

সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা করা হয়। ওই সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, আমদানি ব্যয়ের আকস্মিক স্ফীতি বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি খাতে ঘাটতি স্ফীত করে টাকার মূল্যমানে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবচিতির সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতির ওপরও চাপ বৃদ্ধি করেছে।

সাধারণত রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ মোট দুই হাজার ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৭২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে এক হাজার ৪৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এদিকে চলতি মুদ্রানীতিতে অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ৩১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্যে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও প্রকৃত আমদানির চিত্র নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, দেশে যে পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির তথ্য আসছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ নামে বেনামে এলসি খুলছে। তাই আসলে আমদানির আড়ালে কী হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা দরকার।
খবর৭১/এস:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here