আধুনিক ফার্স্ট ফুডের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শীতকালের ঐতিহ্যবাহী খাবার মুড়ির মোয়া মুখরোচক খাবার

0
1705

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী খাবার মুড়ির মোয়া মুড়ির মোয়া শীতকালে বাঙালীর এক মুখরোচক খাবার। গুড় ও মুড়ি সমন্বয়ে ঘরে তৈরী এই মুড়ির মোয়া ছিল খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু কালের চক্রে আধুনিক ফার্স্ট ফুডের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী খাবার মুড়ির মোয়া। এখন আর গাঁয়ে গাঁয়ে হেটে হেটে ডেকে ডেকে ফেরি করে কেউ মুড়ির মোয়া বিক্রি করে না। দোকানে দোকানে কেউ মুড়ির মোয়া আর সাজিয়ে রাখে না। যার ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী এই মুড়ির মোয়ার নাম ভুলে যেতে বসেছে। আখের রস থেকে তৈরী রশি গুড় চুলায় জাল দিতে দিতে চিটচিটে করে মুড়ির সাথে মেখে তৈরী করা হতো মুড়ির মোয়া। মুড়ির মোয়ার ডাইস ছিল টিনের গোল ঢাকনা। মুড়িগুলো গুড়ের সাথে মেখে পরে টিনের মুখের ডাইসে দিয়ে চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়া তৈরী করা হতো। আর এই চ্যাপ্টা গোলাকৃতির মোয়াই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মোয়া। প্রবীণেরা জানিয়েছেন, মুড়ির মোয়া খাওয়া বাঙালী নারী-পুরষ ও শিশুদের যুগ যুগের সংস্কৃতি। শীত এলেই কটকতারা, বটেশ্বর ইত্যাদি মোটা ধানের মুড়ি আর রশিগুড় দিয়ে তৈরী করা হতো মুড়ির মোয়া। বাঙালী মহিলারা মুড়ির মোয়া বানিয়ে মাটির পাতিলে রেখে মাটির সরা দিয়ে ঢেকে রেখে দিতো। এতে মাসব্যাপী মুড়ির মোয়া মচমচে থাকতো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গ্রামের বাঙালী শিশু-কিশোররা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে বাঙালী মায়েরা সকালের নাস্তা তৈরী হবার পূর্ব পর্যন্ত মুড়ির মোয়া দিয়ে শিশু-কিশোরদেরকে ভূলিয়ে রাখতো। প্রবীণদের মতে, শীতের সকালে মুড়ির মোয়া খাওয়ার একটি বৈজ্ঞানিক কারণ ছিল। তা হচ্ছে মচমচে মুড়ির মোয়া চিবুলে শরীর গরম হতো। যার ফলে শীত কম লাগতো। একবার মুড়ির মোয়া তৈরী করলে একটি পরিবারের এক মাস চলে যেতো। মুড়ির মোয়ার একটি বাণিজ্যিক দিকও ছিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মুড়ির মোয়া তৈরী করে দোকানে দোকানে সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মুড়ির মোয়ার দাম ছিল খুবই কম। চাল ও গুড়ের দাম কম ছিল বলে মুড়ির মোয়ার দাম কম ছিল। দোকানদাররা সরিষার তেলের টিন কেটে আয়না লাগিয়ে মুড়ির মোয়া থরে থরে সাজিয়ে রাখতো দোকানে। মানুষ দোকান থেকে এসব মুড়ির মোয়া কিনে নিয়ে খেতো। অনেকে মুড়ি মোয়া কিনে মাঠা বা গুল বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাখন নিয়ে মোয়ার ওপর মেখে খেত। গ্রামের বিধবা মহিলারা মুড়ির মোয়া তৈরী করে আয়নাওয়ালা টিনের ‘কাতিতে’ (তেলের টিনের অর্ধেক কেটে আয়না লাগিয়ে তৈরী করা হতো কাতি) ভরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে “মোয়া রাখবেন গো মোয়া” বলে ডাকাডাকি করতো। তখন গ্রামের মায়েরা যারা মোয়া তৈরী করতে পারতো না, তারা পাটকাঠি, ধান, চাল ইত্যাদির বিনিময়ে মোয়া কিনে রাখতো। গ্রামা লে মোয়া বিক্রি হতো পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে। তখন বাজার-বন্দরে কখনোই পিঠা বা কোনো প্রকার ফার্স্ট ফুড বিক্রি হতো না। কেউ পিঠা বিক্রি করলে তার সাথে গ্রামের মানুষ সম্পর্ক রাখতো না। এখন এই মোয়ার বাজার দখল করে নিয়েছে ফার্স্ট ফুড এবং বিভিন্ন পিঠা। আলুপুরি, ডালপুরি, সিংগাড়া, সমুচা, চটপটি ও ফুচকাসহ আটার তৈরী বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক ক্ষতিকর খাবার মোয়ার বাজার দখল করে নিয়েছে। চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা ইত্যাদি পিঠাপুলিও এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব ফার্স্ট ফুড ও বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরী পিঠা খেয়ে খেয়ে মানুষ গ্যাষ্ট্রিক, আলসারসহ বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ ও কিডনি রোগের মতো কঠিন অসুখে। অথচ মুড়ির মোয়া ছিল একটি স্বাস্থ্যকর মুখরোচক খাবার। যুগ যুগ ধরে এই মুড়ির মোয়া খাওয়ার পর কোনো মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে এমন ঘটনা জানা যায়নি। এই মুড়ির মোয়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার। ধান থেকে চাল, চাল থেকে মুড়ি। আখ থেকে গুড়, গুড় থেকে চিটেগুড়। এই হচ্ছে মুড়ির মোয়ার উপকরণ। মুড়ির মোয়ায় কোনো রাসায়নিক পদার্থ নেই। প্রবীণরা জানিয়েছেন, মুড়ির মোয়া হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে চাল ও গুড়ের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। পাকিস্তান শাসন আমল থেকে বাংলাদেশ আমলের ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সরকার খাদ্যে ভর্তুকি দিতো। যার ফলে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এক কেজি চাল বিক্রি হতো ১০ আনা থেকে ১৪ আনা। গুড়ের দামও ছিল খুবই কম। এক কেজি গুড় বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন এক কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকারও বেশি দরে। এক কেজি গুড়ের দাম চিনির চেয়েও বেশি। এক কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে। আর ১ কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে। গুড়েও রয়েছে ভেজাল। গুড়ের দাম বেশি বলে অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড়ের রসে চিনি ও কেমিকেল মিশিয়ে ভেজাল গুড় বানিয়ে ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি করছে। চিনি মিশ্রিত বা ভেজাল গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া বানালে তা আর মচমচে থাকছে না। মোয়া বানানোর পরপরই মোয়ার মুড়িগুলো চুপসে যাচ্ছে। যার ফলে অনেকেই এখন আর মোয়া তৈরী করছে না। তবে দেশের কোনো কোনো প্রত্যন্ত অ লে ভিন্ন গোলাকৃতির কিছু মোয়া তৈরী হচ্ছে। তবে দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ এসব মোয়া কিনে খেতে পারছে না। জনগনের ব্যবহার উপযোগী করে তুলুন।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here