ভারত থেকে ঢুকছে পানি,একের পর এক ডুবছে গ্রাম

0
25

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে আরেক দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি জেলায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। সময় যতই গড়াচ্ছে বন্যার ভয়াবহতা ততই বাড়ছে। যেসব জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। হাজারো মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে এসব জায়গায়। এমন পরিস্থিতিতে এসব এলাকা পুরোপুরি বিদ্যুতহীন হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্কও।

ফেনী ছাড়াও সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও খাগড়াছড়ি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও বিস্তৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভয়াবহ পরিস্থিতি ফেনীর

ফেনীর নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় ১৯৮৮ সালের পর বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়নি আগে কখনো। ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, সবার কল্পনার বাইরে। এখন অনেক মানুষ পানিতে আটকা পড়েছে। তাদেরকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড।’

বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘খোয়াই, ধলাই, মুহুরী, হালদা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা তা অব্যাহত থাকতে পারে।’

বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে মাঠে নামিয়েছে জেলা প্রশাসন।

কুমিল্লা-নোয়াখালী-চট্টগ্রামের বাড়ছে পানি

কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পাশাপাশি ঢলের পানি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়।

কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় কুমিল্লা সদর উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বাড়িঘর, ফসলি জমি রাস্তা ঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে নোয়াখালী জেলায়ও। জেলা সদর, সোনাইমুড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় তৈরি হয়ে তীব্র জলাবদ্ধতা।

নোয়াখালীর মাইজদীতে হাঁটুপানি জমেছে শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায়। অনেক এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে পানির নিচে।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের কারণে আগে থেকেই পানি জমেছিল বিভিন্ন জায়গায়। সেই সাথে নতুন করে বন্যার পানি আসতে শুরু করে মঙ্গলবার থেকে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির শতাধিক গ্রাম তলিয়েছে পানির নিচে। এই উপজেলার মাছের খামার, ঘরবাড়ি ডুবে গেছে বন্যার পানিতে।

এই এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গত তিন দশকেও এই এলাকায় এমন বন্যা পরিস্থিতি দেখেননি তারা। এলাকার পানিবন্দি অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে টানা চারদিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধ-লাখ পরিবার। ঢলের স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ সড়ক।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘ওইসব এলাকা ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর পানি সমতল বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

আখাউড়ায় একের পর এক গ্রাম প্লাবিত

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্দরের সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি ইমিগ্রেশন ভবনে হাঁটুপানি জমায় যাত্রী পারাপার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

জানা যায়, মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) মধ্যরাত থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আজ সকাল থেকেই পানিতে ডুবে যায় আখাউড়া স্থলবন্দর। তলিয়ে যায় স্থলবন্দরের সড়কটি। এতে পণ্য আমদানি রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এছাড়া আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ভবনেও পানি ঢুকেছে। ফলে যাত্রী পারাপার কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থলবন্দর সড়কের পাশে আমদানি-রফতানিকারকদের বেশ কয়েকটি অফিসও তলিয়ে গেছে।

এদিকে ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যায় আখাউড়া উপজেলার বীরচন্দ্রপুর গ্রামে পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী মারা গেছেন। ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় তিনি তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে পানিতে ডুবে যান। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বানের পানিতে ইতোমধ্যে ১০টির মতো গ্রাম ডুবে গেছে। পানির তোড়ে একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাত থেকে আখাউড়ায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সকাল থেকে বন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে ভারত থেকে তীব্র বেগে পানি ঢুকতে থাকে। একপর্যায়ে স্থলবন্দর, বাউতলা, বীরচন্দ্রপুর, কালিকাপুর, বঙ্গেরচর, সাহেবনগরসহ অন্তত ১০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করে। ভেঙে যায় গাজীরবাজার এলাকার অস্থায়ী সেতু।

এর আগে মঙ্গলবার খলাপাড়া এলাকায় হাওড়া নদীর বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন। সঙ্গে ছিলেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাপস কুমার চক্রবর্তী।

মৌলভীবাজার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি

মৌলভীবাজারে দ্বিতীয় দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই আবারও বন্যার কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে জুড়ি, কুলাউড়া ও বড়লেখার হাওরের পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে রাজনগর উপজেলার একামধু ও ভাঙ্গারহাটহাট গ্রামে মনুনদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে।

পাউবো ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গেল কয়েকদিন থেকে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলা সবক’টি নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর অবস্থান করছে। জেলার রাস্তাঘাট ও নিম্নাঞ্চলের বাসা-বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। জেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে জনপদে পানি প্রবেশ করায় দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো বাসিন্দা।

flood-3

এছাড়াও জেলা সদরসহ রাজনগর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী উপজেলার নানা জায়গায় লোকালয়ে ও ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, চলমান বৃষ্টিতে রোপা আমন ধান ১৩৪৪ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতিও নিরূপণ চলছে।

হবিগঞ্জে বিপদসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপরে খোয়াই নদীর পানি

হবিগঞ্জে হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং নদীর উজানে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) দিবাগত মধ্যরাতের পর থেকে নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে। বুধবার সকাল থেকেই পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে থাকে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, খোয়াই নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। গত দু’দিন প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার দুপুর ১২টায় খোয়াই নদীর মাছুলিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বাল্লা পয়েন্টে ২৩১.৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here