বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলছে

0
60

সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে দেওয়া প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের দাবিতে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণারা হিড়িক পড়েছে।

কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের দেওয়া কর্মসূচির বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা যখন কোটাবিরোধী এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতিতে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা ও অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে একই সময়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুই তরফ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতির ফলে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল প্রশাসনিক কার্যক্রমও।

শিক্ষকদের আন্দোলনে শিগগিরই একটা সুরাহার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরতে নারাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় গ্রুপ ও ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

ঢাবির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন বলেন, আমরা কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছি৷ সুযোগের সমতা নিশ্চিতে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন শেষ করে ক্লাসে ফিরলেও আগামী রবিবার ১৫ তম ব্যাচের কেউ ক্লাসে ফিরবে না। কোনো ক্লাস শিডিউল দেওয়া হবে না। সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করা হলো।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাসুদ আহম্মেদ সানী বলেন, কোটা পুনর্বহাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রহসন। শিক্ষার্থীরা এ প্রহসন মেনে নেবে না। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধা-ভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে; পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্মের আগামী কর্মসূচির সাথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ একাত্মতা পোষণ করছে। আমরা আগামী রোববার থেকে কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরবো না। যত দিন না আমাদের দাবি আদায় হবে, ততদিন আমরা আমাদের সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করলাম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হাবিব রেজা বলেন, চলমান কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের আগামী কর্মসূচির সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ইতোমধ্যে একাত্মতা পোষণ করেছে। শিক্ষকেরা তাদের আন্দোলন শেষে ক্লাসে ফিরলেও কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সমাধান নাহলে আগামী রোববার থেকে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মোখলেছুর রহমান সুইট বলেন, বৈষম্যমূলক কোটাবিরোধী আন্দোলনে সকল শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছে। আগামীর কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দেওয়া শুরু করেছে। ওদিকে শিক্ষকেরাও পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছে। কোটার বিষয়ে কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই যদি শিক্ষকদের দাবি সরকার মেনে নিয়ে তাদের ক্লাসে ফিরে যেতে বলে তখনও শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না।

সার্বিক বিষয়ে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা অনলাইন এবং অফলাইনে জনসংযোগ চালিয়েছি। ঢাবি থেকে আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। এ পর্যন্ত ৪৭টি বিভাগের সকল ব্যাচ আমাদের আন্দোলনে পূর্ণ সংহতি জানিয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৬টি বিভাগ আংশিকভাবে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। এখনও অনেক বিভাগ ও ব্যাচ ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমরা অনেক সাড়া পেয়েছি। এমনকি আনন্দমোহন কলেজ থেকেও ক্লাস বর্জনের কথা আমরা জানতে পেরেছি। আমরা মনে করি এটা আমাদের বড় অর্জন। আমাদের ৪ দফা দাবি না মানলে আমরা রাজপথ ছাড়বো না। আমরা বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরবো।

এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বর্জনকারী বিভাগ ও ইন্সটিটিউট সংখ্যা ৬৩টি। এর মাঝে ৪৭টি ব্যাচ ও ইন্সটিটিউটের সকল ব্যাচ ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। বাকি ১৪ বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের কয়েকটি ব্যাচ ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা করেন। তবে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাছাড়া জাবি, জবি, রাবি, চবি, ইবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ থেকেও ক্লাস বর্জনের ঘোষণা এসেছে।

এদিকে, চলমান শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় সেশনজটের শঙ্কায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীরা৷ এর আগে দেশে ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছিলো। এতদিনে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর কথা থাকলেও তারা এখনও পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। এমতাবস্থায় আবারও শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিলে ফের সেশনজটের শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল (নিয়মিত আপিল) করতে বলেছেন আদালত।

গেল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আজকের শুনানিতে আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বলেন, আপাতত হাইকোর্টের রায় যেভাবে আছে, সেভাবে থাকুক। রায় প্রকাশ হলে আপনারা নিয়মিত আপিল দায়ের করেন। আমরা শুনব।

যেভাবে শুরু আন্দোলন
২০১৮ সালের অক্টোবরে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।

সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা চায় না। তারা আন্দোলন করেছে। ফলে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আর আলোচনা করার বা হা-হুতাশ করার কিছু নেই।

তবে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন।

সে রিটের শুনানি নিয়ে কেন ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।

ওই রুলের বিষয়ে শুনানি শেষে গেল ৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ। মূলত এই রায়ের পর থেকেই আন্দোলন শুরু হয় বিভিন্ন বিশ্বাবিদ্যালয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here