খবর৭১ঃ
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান রোববার রাতে রাজধানী আঙ্কারায় তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন- তার প্রথাগত ‘ব্যালকনি (বারান্দা) বক্তৃতা’ দিতে। যেমনটা তিনি করেছেন বিগত দুই দশকে তুরস্কের প্রতিটি নির্বাচনের পর। যেখানে তার সমর্থকরা ছিলেন উচ্ছ্বসিত, বিপরীতে উদ্বিগ্ন ছিলেন ভিন্নমতাবলম্বীরা।
অবশ্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখনো শেষ হয়নি। আগামী ২৮ মে দ্বিতীয় রাউন্ড হবে। তবে সম্ভবত এরদোগানই জিতবেন, যিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিকদারোগ্লুর থেকে চার পয়েন্টের বেশি এগিয়ে আছেন। তার ক্ষমতাসীন জোট ইতোমধ্যে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।
অন্য কথায় বলতে গেলে, গত ২০ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পর এরদোগান আরও পাঁচ বছরের জন্য তুরস্ক শাসন করার সুযোগ পেতে পারেন। যদি এর বেশি না হয়- তাহলে ১৯ শতকের শেষের দিকের অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের পর অন্য যে কোনো তুর্কি শাসককে (ক্ষমতায় থাকার দিক থেকে) ছাড়িয়ে যাবেন তিনি।
অনেকেই মনে করছেন, এরদোগান জিতলে আগামী পাঁচ বছর আশাব্যঞ্জক হবে না। সর্বোপরি এরদোগান ইতোমধ্যে তুরস্ককে যে একটি আধা-একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন, সেটা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। স্বাধীন বিচার বিভাগ, মুক্ত গণমাধ্যম এবং সমালোচনামূলক একাডেমিয়ায় যা কিছু অবশিষ্ট আছে- তাও তিনি নির্মূল করতে পারেন। তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন, যেখানে ধর্মীয় অধিকারের আরও অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
এরদোগান-পন্থিদের পরামর্শের মধ্যে রয়েছে- সাংবিধানিক আদালত বিলুপ্ত করা, গণশিক্ষায় ধর্মকে আরও বেশি অন্তর্ভুক্ত করা, নারীর স্বাধীনতা খর্ব করা এবং ইসলামের ‘ধর্মবিরোধী’ (লিবারেল) ব্যাখ্যা নিষিদ্ধ করা।
কিন্তু এরদোগান কীভাবে জয়ী হতে চলেছেন- বিশেষ করে এমন সময়ে- যখন অনেকেই ভেবেছিলেন যে, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি এবং সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তার সমর্থন মুখ থুবড়ে পড়বে?
এর জবাব কিন্তু এই নয় যে, তিনি ভোট ‘চুরি’ করেন। বরং তুরস্কে বাক-স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের নাটকীয় পতন নিয়ে অনেকের অভিযোগ সত্ত্বেও দেশটিতে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনি ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে এরদোগান সত্যিই ব্যালটের মাধ্যমে জয়লাভ করেন।
সত্যি কথা হলো- এরদোগান তুরস্কের বৃহত্তম আর্থ-রাজনৈতিক ব্লক তথা ধর্মীয় রক্ষণশীলদের সঙ্গে একটি অটুট বন্ধন তৈরি করেছেন। তিনি তাদের একটি দুর্দান্ত ন্যারেটিভ (নিজের মত, মতবাদ, চিন্তা, দর্শন) দিয়েও মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। ঘৃণ্য শত্রু এবং জঘন্য ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তিনি তুরস্ককে আবার গ্রেট ও মুসলিম তথা ইসলামিক করে তুলছেন।
তুর্কি জাতির সঙ্গে নানা ষড়যন্ত্র, মিডিয়ার বিশাল প্রোপাগান্ডা ও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। অথচ এক সময় অর্থাৎ অটোমান সাম্রাজ্যের যুগে তুর্কিরা বিশ্বের ‘প্রভু’ ছিল। পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ১৯২০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তুরস্কে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তাদের শাসনামলে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া, নারীদের মাথার স্কার্ফ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নানাভাবে অপমান করা হয়েছিল। একমাত্র এরদোগানই সেই দীর্ঘ অবমাননার অবসান ঘটিয়েছেন।
তুরস্ককের জনগণকে আবারো সেই অবমাননার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাই তো এরদোগানকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে বিরোধীরা। এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীরা। ধর্মনিরপক্ষ বা উদারপন্থি, উদারপন্থি সমালোচক, পশ্চিমা মিডিয়া, পুঁজিবাদী ক্যাবলস, জর্জ সোরোস, মার্কিন ডিপ স্টেট, ইউরোপীয় আদালত, কুর্দি সন্ত্রাসবাদী, এলজিবিটিকিউ কর্মী, এমনকি ধর্মীয় শিবিরের দলত্যাগকারীরা এই ষড়যন্ত্রের অংশ।
এদের বিপরীতে এরদোগানপন্থিরা চিৎকার করে বলছেন, ‘ইয়েদিরমেইজ!’। এটি একটি স্লোগান, যার মোটামুটি অর্থ হলো- ‘আমরা তোমাদের আর সেটা করতে দেব না!’
সম্ভবত পশ্চিমের খুব কম লোকই লক্ষ করেছেন, কিন্তু এই নির্বাচনের জন্য এরদোগানের প্রচারে দুটি নতুন ‘যুদ্ধ মেশিনের’ ঘোষণা ছিল। একটি হলো- তুরস্কের প্রথম ড্রোন বিমানবাহী রণতরী টিসিজি আনাদুলু এবং দেশটির নতুন জাতীয় যুদ্ধ বিমান ‘কান’। উভয়টিই বিশাল জনসমাগমের সঙ্গে উন্মোচন করা হয়েছিল। এরদোগান জেট পাইলটের ইউনিফর্ম পরা দৃঢ় ভঙ্গিতে তার একটি ছবি দিয়ে টুইটার প্রোফাইল আপডেট করেন। এর দুই সপ্তাহ পর তিনি ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়া মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রচার করেন। প্রায় ৮৬ বছর পর তিন গ্রীষ্ম আগে এটিকে তিনিই মসজিদে রূপান্তর করেন। তার আগে এটি ছিল গির্জা, যদিও শুরুতে ছিল মসজিদ।