খবর৭১ঃ
সারা দেশে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন বয়স্ক ও শিশুরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, চলমান দাবদাহে অসুস্থ হয়ে পড়া বয়স্ক, শিশু ও কোমরবিডিটি (বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত) সম্পন্নদের তাৎক্ষণিক পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
দেশে গত শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে ১৯৬৫ সালে রাজধানীতে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছিল। এমন পরিস্থিতিকে জাতীয় দূর্যোগ ঘোষণা দিয়ে বিষেশজ্ঞরা এটি মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগের মেডিসিন বিভাগের প্রধান আবাসিক চিকিৎসক (আরএস) শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, গত কয়েক দিন ধরে গরমে হাঁসফাঁস করছে সারা দেশের মানুষ। তীব্র আকার ধারণ করেছে তাপপ্রবাহ।
বেশ কয়েক দিন হলো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হওয়া রোগী আসছে। ঢাকাসহ আশপাশের অনেকেই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তাদের অনেকে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, বমি, মাথাব্যথা, হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, বমি, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের কথা বলছেন। অনেকে গলাব্যথা, কাশি, সর্দি ও ঘুমের সমস্যা বেড়ে যওয়ার কথা বলছেন।
ইমিরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে গত কয়েক দিন ধরে যে মাত্রার তীব্র গরম পড়ছে, তাতে যে কেউ যে কোন সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এক্ষেত্রে কৃষক, রিক্সাচালকসহ যাদের রোদে পুড়ে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের কাজ করতে হয়, তাদের গরমজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, বয়স্ক ও শিশুরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন।
তিনি বলেন, তীব্র গরমে ড্রিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে পানিশূন্যতা বা স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। অনকের রক্তচাপ ও প্রস্রাব কমে যেতে পারে। গরমে শরীরে তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির উপরে উঠলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও পালস (নাড়ির স্পন্দন) কমে যেতে পারে। এ সময়ে ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন তারা পানির সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে স্যালাইনের মতো প্রস্তুত করে খেতে পারেন। এতে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বেড় হওয়া লবণের ঘাটতি পূরণ হবে। সবাইকে ঢোলাঢিলে সূতি কাপড় পড়তে হবে।
আবহাওয়াবিদরা যুগান্তরকে বলছেন, এ মুহূর্তে দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে যে বাতাস প্রবেশ করছে, তা কিছুটা জলীয় বাষ্প বয়ে আনছে। এতে বাতাসের আর্দ্রতা আরও বেড়ে যাওয়ায় শরীরের ঘাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরম আর শুষ্ক বাতাস মিলে স্থুলকায়, বয়স্ক, শ্রমজীবী ও শিশুদের কষ্ট আরও বেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, রোজার মাসে তীব্র দাবদাহে বেশি সমস্যা হচ্ছে শরীরে পানিশূন্যতা। এক্ষেত্রে যারা ষাটোর্ধ অথবা যাদের বয়স ১০ বছরের কম তারা বারবার পানি পান না করলে ডি-হাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে পানিশূন্যতা বেশি দেখা দিতে পারে।
শরীরের রক্তচাপ কমে যেতে পারে। কিডনি বিকল রোগীদের কিডনিতে চাপ পড়তে পরে। যারা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খাচ্ছেন গরমে তাদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
প্রখর রোদে বেশি সময় বাইরে অবস্থান করলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যার লক্ষণ মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করা, মাথা ঘোরা, হার্টের ওপর চাপ তৈরি হয়ে কলাপস (রক্তচাপ কমে গিয়ে অজ্ঞান হওয়ার প্রবণতা) হতে পারে।
মোটা বা স্থুল ব্যক্তিদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে গিয়ে দ্রুত সংকট তৈরি হতে পারে। চর্মরোগীদের স্কিন ডিজিজ বেড়ে যেতে পারে। অধিক রোধে স্ক্রিন বার্ণ বা ত্বক পুড়ে যেতে পারে। ডায়রিয়া হতে পারে।
চিকিৎসকরা যুগান্তরকে বলেন, গরমে অ্যাজমা রোগীদের ২৪ ঘন্টায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি করতে হবে। অতিরিক্ত ঘামে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বা শরীরের লবণের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে মোটা, কিডনি বিকল রোগী ও বয়স্কদের বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়।
ডায়াবেটিস, হাপানি ব্রংকাইটিস, কেমোথেরাপি চলমান ক্যানসার রোগী ও স্টেরয়েড ওষুধ সেবনকারীদের তাপপ্রবাহ এড়িয়ে চলতে হবে। হাপানি, অ্যালার্জি, রাইনাইটিস, গলাব্যথা, গলার প্রদাহ থাকলে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান থেকে বিরত থাকতে হবে। ছায়া-শীতল পরিবেশে থাকতে হবে।
ঢাকা মেডিকলে কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ যুগান্তরকে বলেন, ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমান সময়ে বাচ্চাদের চিকেন পক্স, মামসসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি হচ্ছে। তবে গরমকালে ধুলাবালি বেড়ে যাওয়া বাচ্চাদের অ্যাজমা ও কাশির প্রকোপ বেড়েছে।
অনেকের ঘামাচি ও পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। তবে আতঙ্কিত না হয়ে তাই বেশি করে গ্লাসে করে স্বাভাবিক পানি পান করানো ও পানিতে কাপড় ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুছে দিতে হবে। নিয়মিত গোসল কারাতে হবে। রোদ এড়িয়ে চলতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, বাংলাদেশে যত মানুষের অকাল মৃত্যু হয়, তার ২০ ভাগ মৃত্যু হয় বায়ু দূষণের ফলে। বায়ু দূষণজনিত কারণে হিট ওয়েভ বা তাপমাত্রার আদ্রতা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে নানা কারণে দেশের বায়ু দূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৪ ভাগ বেড়ে গেছে। এছাড়া ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জমাট পানিতে এডিস মশার ডিমপাড়া, লার্ভা ও বংশবিস্তার বেড়ে যায়। ছাড়পোকার মতো ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বংশ বিস্তারের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাই আবহাওয়ার তাপমাত্রা নিয়ন্তণে সচেতন হতে হবে