দেশ ছাড়ছে শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্তরা

0
164

খবর ৭১: শ্রীলঙ্কায় গত বছর চরম অর্থসংকটের মুখে জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের জন্য মানুষের যে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছিল, প্রায় একই অবস্থা ছিল দেশটির অভিবাসন বিভাগের সামনেও। ২০২২ সালে লঙ্কান অভিবাসন কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮ লাখ ৭৫ হাজার পাসপোর্ট ইস্যু করেছে, যা তাদের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ। কলম্বোর এ ভবনটির বাইরে অপেক্ষমান মানুষগুলো চরম অভাব, মূল্যস্ফীতি ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা খুঁজছিল।

শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ। সরকারি হিসাব বলছে, ২০২২ সালে দেশটি থেকে তিন লাখ মানুষ চাকরির জন্য বিদেশে গেছে। এদের বেশিরভাগই নিম্ন ও আধা-দক্ষ শ্রমিক। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে গেছে আরও ৭৩ হাজার। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশত্যাগের এই স্রোতে গা ভাসিয়েছে মূলত শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্ত পেশাজীবীরা।

তাদের দেশত্যাগের বহু কারণ তৈরি করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। গত ফেব্রুয়ারিতে সেখানে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই তুলনায় মজুরি বাড়েনি। কিন্তু বেড়েছে করের বোঝা। গত জানুয়ারিতে লঙ্কান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে আইএমএফের বহুল প্রতীক্ষিত ঋণ পেতে কর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

যদিও এই সিদ্ধান্ত শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘ব্রেইন ড্রেইন’ (মেধা পাচার) ঘটাবে বলে সতর্ক করেছে বিরোধী ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টি। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যও হতে পারে।

৩৭ বছর বয়সী এয়ার-ট্রাফিক কন্ট্রোলার রাজিথা সেনেভিরত্নে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাওয়া একটি চাকরির প্রস্তাব বিবেচনা করছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, বিদেশি রিক্রুটমেন্ট এজেন্টরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণ পেশাদারদের নিয়োগ দিচ্ছে। তবে গত মাসে রাজিথাদের ইউনিয়ন সতর্ক করে বলেছে, যদি তাদের আরও চার বা পাঁচজন সদস্য চলে যায়, তাহলে এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

শ্রীলঙ্কায় হাজার হাজার তরুণ শ্রমিক পদত্যাগ করেছে। এতে দেশটির দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। শত শত চিকিৎসক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যাদের মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যেই গেছেন ৪৭৭ জন। এভাবে অব্যাহতভাবে চিকিৎসকদের বিদেশ গমন দেশটির গ্রামীণ হাসপাতালগুলোকে পঙ্গু করে দিতে পারে।

শোনা যায়, উচ্চ অভিবাসন হারের বিষয়ে খোদ বিক্রমাসিংহেই ব্যঙ্গ করে বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় খুব শিগগির ‘হোটেলে এক গ্লাস ওয়াইন পরিবেশন করার মতো কেউ অবশিষ্ট থাকবে না’।

এরপরও সরকারি খাতের মজুরি বিল কমানো ও দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার বৃহত্তম উত্স রেমিট্যান্স বাড়ানোর আশায় ‘ব্রেইন ড্রেন’কে উত্সাহিত করছে লঙ্কান সরকার। পলাতক চিকিৎসকরা সরকারি কর্মীদের জন্য গত জুনে চালু হওয়া একটি বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন। এ ব্যবস্থায় তারা বিদেশে কাজ করে যদি মাসে ১০০ থেকে ৫০০ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান, তবে পাঁচ বছর পর্যন্ত অবৈতনিক ছুটি মঞ্জুর করবে সরকার।

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী মানুশা নানায়াক্কারা বিদেশে কর্মী পাঠাতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছেন। তার অফিস সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদেশে চাকরির সুযোগের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। রাষ্ট্রপরিচালিত কর্মসংস্থান সংস্থার মাধ্যমে লঙ্কান নাগরিকরা বিদেশে চাকরি নিশ্চিত করতে পারে, তার প্রচারণা চালাতে ‘রাতা ইয়ামু’ বা ‘চলুন, বিদেশে যাই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও ইউটিউব চ্যানেল খোলা হয়েছে।

সরকার নার্সিং, কেয়ার-গিভিংসহ অন্যান্য পেশায় প্রশিক্ষণের ‍সুযোগ বাড়িয়েছে। বিদেশে এসব পেশার জন্য শ্রীলঙ্কানদের চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে কুয়েত, কাতার এবং সৌদি আরবে। গত বছর শ্রীলঙ্কার ৪০ শতাংশেরও বেশি নিবন্ধিত অভিবাসী এসব দেশে গেছে। এছাড়া, নতুন নতুন ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। এতে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও।

লঙ্কান সরকারের এই নীতিগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলছে বলেই মনে হচ্ছে। গত বছর কমে যাওয়া রেমিট্যান্স গত চার মাসে আবার বেড়েছে। তবে উজ্জ্বলতম প্রতিভাগুলোকে বিদেশে ঠেলে দিয়ে শ্রীলঙ্কা নিজের ঘর পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় লোক থেকে নিজেকেই বঞ্চিত করছে। এটি দ্বীপরাষ্ট্রটির জন্য অদূর ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here