বিজয়ের ৫০ বছরে তাজিংডং বিজয়

0
388

খবর৭১ঃ স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষায় ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড় এবং ‘ডং’ শব্দের অর্থ পাহাড়। এই দুটি শব্দ থেকে তাজিংডং পর্বতের নামকরণ হয়েছে। সরকারিভাবে তাজিংডং পাহাড়কে বিজয় নামে ডাকা হয় এবং এটাকেই দেশের সর্বোচ্চ পর্বত বলে অফিশিয়ালি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যদিও অনেকে সাকা হাফংকে সর্বোচ্চ পর্বত বলে মনে করেন।

তাজিংডং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে সাইচল পর্বতসারিতে অবস্থিত। এটি রুমা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে হলেও থানচি থেকেই যাওয়াই সুবিধাজনক। তাজিংডং পর্বতের উচ্চতা ১ হাজার ২৮০ মিটার বা ৪২০০ ফুট। তবে অনেকের মতে এর উচ্চতা আরও কম।

এই বছর দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর হবে এবং সেই সঙ্গে টানা তিন দিন ছুটি পাওয়া যাবে ভেবে বেশ আগে থেকেই পরিকল্পনা করি তাজিংডং বিজয় করার জন্য। এছাড়াও অন্য আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো আমার ইউটিউউব চ্যানেল ‘গো উইথ আশরাফুল আলম’ এর জন্য কন্টেন্ট বানাব। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৫ ডিসেম্বর বুধবার অফিসের পাঠ চুকিয়ে রাতের বাসে রওনা দিই বান্দরবনের উদ্দেশ্য কিন্তু কপাল খারাপ! তিন দিনের টানা ছুটিতে রাস্তার বেশ যানজটের কবলে পড়ে যাই। সকাল ছয়টার মধ্যে বান্দরবন পৌঁছানোর কথা থাকলেও পৌঁছায় দুপুর দেড়টায়। এর মধ্যে আবার একবার গাড়ি নস্ট হয়ে গিয়ে বেশ যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল।

সকালের নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবার যাই বলি না কেন সেটা সেরে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে থানচি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। সব ঘুছিয়ে যখন রওনা দিব তখন রাত আটটা বাজে। সামনে আমাদের প্রায় আট ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হবে যেটা আমাদের জন্য তখন প্রায় অসম্ভব ছিল কেননা আগের দিন অফিস করে সারারাত বাস এবং চান্দের গাড়ির জার্নি করে আমরা বেশ কাহিল। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন হওয়া তমাতুংগির রাস্তা ধরে ১৩ কিলোমিটার যাব চান্দের গাড়িতে এতে করে আমাদের চার ঘণ্টা ট্রেকিং কমবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা আমাদের টিম লিডার টিজিবি’র মামুন ভাইয়ের নেতৃত্বে এগিয়ে গেলাম। ১৩ কিলো নেমে যখন ট্রেকিং শুরু করলাম তখন বেশ ভালোই লাগছিল। চারিদিকে চাঁদের আলোর মাঝে আমরা একদল তরুণ তরুণী প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা পেলাম আদিবাসীদের গ্রাম কাইটং পাড়ার। সেখানে বেশ খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু।

হঠাৎ সামনে প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় দেখে চোখ কপালে উঠল! এখন এটা পাড়ি দিতে হবে যেটা আবার প্রায় ২০০ ফিট লম্বা। খাড়া পাহাড় বেয়ে যখন উঠছিলাম তখন মনে হচ্ছিল কেন যে আসতে গেলাম! আর কখনই এভাবে ট্রেকিং করতে বের হব না কিন্তু উঠার পর যখন একটু বিশ্রামের জন্য থেমেছিলাম তখন মনে হয়েছিল প্রকৃতি এত সুন্দর, এত সুন্দর যেটা আসলে পাহাড়ে না আসলে কখনই বুজা যাবে না। এটা আসলে অনুভব করে নিতে হয়। এই জন্যই হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তার কবিতায় লিখেছিলেন- ‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ, কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না, যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না’।

বেশ খানিকটা চড়াই উতরাই পেরিয়ে যখন তাজিংডংয়ের বেজ ক্যাম্পখ্যাত ‘শেরকর পাড়া’য় পৌঁছালাম তখন রাত বারোটা বেজে বিশ মিনিট। এরপর শান্তির আহার কেননা আসার পথে শুধু মাত্র খেজুর এবং বাদামই ছিল সম্ভল। অবশ্য এর বেশি খাওয়া যেত না, খেলে হাঁটতে অনেক কষ্ট করতে হত। রাতের খাবার সেরে চাঁদের আলোয় ক্যাম্প ফায়ারের সামনে গিটার হাতে আমাদের দলের সদস্যরা যখন গান বাজনা করেছিল তখন সেটা হয়ে উঠেছিল জীবনের অন্যতম সেরা একটি রাত।

সকাল ১১:৩৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশের অফিসিয়ালি সর্বোচ্চ চূড়া তাজিংডং বিজয় করতে পেরেছি। তবে এর আগে অবশ্য শেরকর পাড়া থেকে ঘণ্টা দুয়েক ট্রেকিং করে আসতে হয়েছে। তাজিংডংয়ের চুড়ায় উঠে যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা কখনো কাউকে বলে বোঝানো যাবে না! ভিতর থেকে শুধু মনে হচ্ছিল কিছু একটা জয় করে ফেলেছি। আরও বারবার মনে পড়ছিল চাইলেই যে কোন কিছু জয় করে ফেলা সম্ভব। আসলে আমাদের দৈন্দদিন জীবনে এমন অনেক ব্যাপার থাকে যেগুলো নিয়ে আমরা বেশ চিন্তায় পড়ি কিন্তু তাজিংডং জয় করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে শুধু মনোবল অটুট থাকলেই যেকোন কিছু জয় করা সম্ভব। আর মনোবল চাঙ্গা করতে হলে এইরকম ট্রেকিং মাঝে মধ্যে করেতেই হবে!

তাজিংডং বিজয় করার পর এই দিনটাও আমরা শেরকর পাড়ায় থেকে যাই। আদিবাসীদের ঘরে থেকে তাদের জুম চাষের লাল চাল, আলুর ভর্তা এবং পাহাড়ি খাবার খেয়ে তাদের জীবনটাকে কাছে থেকে বোঝার চেষ্টা করি। এই পাড়ার মানুষজন আমাদের কাছে খাবার এবং খাকার জন্য নিয়েছিল নামমাত্র মূল্য যেটা সব মিলিয়ে দিনে জনপ্রতি পাঁচশ টাকার মতো তবে লম্বা ছুটির কারনে বান্দরবন থেকে থানছি যাওয়া আসার চান্দের গাড়ি যেখানে আট-নয় হাজার টাকা নেয় সেটা আমাদের কাছ থেক নিয়েছিল চৌদ্দ হাজার করে। এ ছাড়া থানছি থেকে ১৩ কিলো পর্যন্ত শুধু মাত্র যাওয়া নিয়েছে দুই হাজার তিনশত টাকা করে। গাইডের খরচ নিয়েছে তিন হাজার করে। আমরা বড় টিম হওয়ায় তিনজন গাইড নিয়েছিলাম যদিও কতজন নিতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না।

একটা বিষয় আমার কাছে বেশ কষ্ট লেগেছে সেটা হল কেউ অসুস্থ হলে এখানে চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আর আদিবাসীদের পড়ালেখার বন্দোবস্তও অপ্রতুল যদিও পার্বত্য উন্নয় বোর্ড বেশ চেষ্টা করছে। এত দুর্গম পাড়ায় এসে বেশ উৎসাহ পেয়েছি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বাচ্চাদের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে।

এবার ফেরার পালা। যান্ত্রিক নগরে ফিরে যেতে হবে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়ি। প্রায় আট ঘণ্টার ট্রেকিংয়ে আমরা কখন চড়াই কখন উতরাই পেরোই। তবে এই দিনের ট্রেকিং বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। যদিও আমাদের তেমনটা কষ্ট হয়নি আগের দুই দিনের কারণে। ঝিরিপথ, জুমঘর এবং বেশকিছু ভ্যালির মতো জায়গা যখন পার হচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল এই পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেলে মন্দ হতো না। অন্তত জীবনটা প্রকৃতির মাঝে উপভোগ করতে পারতাম!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here