খবর৭১ঃ থায়রয়েড গ্রন্থি একটি অতি প্রয়োজনীয় অন্ত:ক্ষরা (এন্ডোক্রাইন/Endocrine) গ্লান্ড (Gland); যা গলার সামনের অংশে অবস্থিত। এটি মানব শরীরের প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্লান্ড। থায়রয়েড থেকে নি:সৃত প্রধান কার্যকরী হরমোনগুলো তৈরি করতে সাহয্য করে টিএসএইস (TSH) নামক আরেকটি হরমোন; যা মস্তিস্কের ভেতর পিটুইটারি (Pituitary) নামের গ্লান্ড থেকে নি:সৃত হয়।
থায়রয়েড হরমোনের অন্যতম কাজ হচ্ছে শরীরের বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট (Basal metabolic) বাড়ানো। থায়রয়েড হরমোনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুর পরিপক্বতা। এজন্য গর্ভাবস্থায় থায়রয়েড হরমোনের স্বল্পতায় গর্ভের বাচ্চা বোকা হয় অথবা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। যেসব উদ্দীপনায় বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় যেমন- যৌবনপ্রাপ্তি, গর্ভাবস্থা, শরীরবৃত্তীয় কোনো চাপ ইত্যাদি কারণে থায়রয়েড গ্লান্ডের আকারগত বা কার্যকারিতায় পরিবর্তন হতে পারে।
থায়রয়েড গ্রন্থি থেকে মূলত দুই ধরনের সমস্যা দেখা যায়, গঠনগত ও কার্যগত। এরা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে।
গঠনগত সমস্যায় থায়রয়েড গ্রন্থি ফুলে যায় যেটাকে গয়টার (Goiter) বা গলগ বলা হয়; যার আবার রয়েছে নানা প্রকারভেদ। এছাড়া থায়রয়েড গ্লান্ডের গোটা বা নডিউল (Thyroid nodule) এবং থায়রয়েড গ্লান্ডের ক্যান্সার (Thyroid Cancer) হতে পারে।
কার্যগত সমস্যা দুই রকমের হয়ে থাকে তা হলো- থায়রয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথায়রয়েডডজম ও থায়রয়েড গ্লান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথায়রয়েডডজম (Hypothyroidism) এছাড়া থায়রয়েড গ্লান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়ডাইটিস (Thyroiditis) হতে পারে।
থায়রয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথায়রয়েডডজম (Hyperthyroidism)
হাইপার থাইরয়ডিজম রোগে থায়রয়েড গ্লান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থায়রয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে
প্রচণ্ড গরম লাগা, হাত পা ঘামা।
পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন পায়খানা হওয়া।
হার্ট ও ফুসফুসীয় সমস্যা: বুক ধড়ফড়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিওর, এনজাইনা বা বুক ব্যথা।
স্নায়ু ও মাংসপেশির সমস্যা: অবসন্নতা বা নার্ভাসনেস, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উত্তেজনা, আবেগ প্রবণতা, সাইকোসিস বা মানসিক বিষাদগ্রস্ততা; হাত-পা কাঁপা, মাংসপেশি ও চক্ষুপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি হতে পারে।
এছাড়া হাড়ের ক্ষয় বা ওস্টিওপোরোসিস, মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
হাইপারথায়রয়েডডজমের কারণ
ক) গ্রেভস ডিজিস (Graves’ disease): এক ধরনের অটোইমিউন রোগ; যাতে থায়রয়েড গ্লান্ড এর পাশাপাশি রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসে।
খ) মাল্টিনডিউলার গয়টার (Multinodular goiter)
গ) অটোনামাসলি ফাংশনিং সলিটারি থায়রয়েড বডিউল (Autonomously functioning solitary thyroid nodule)
ঘ) থায়রয়েড গ্লান্ডের প্রদাহ বা থায়রয়েডাইটিস (Thyroiditis)
ঙ) থায়রয়েড গ্লান্ড ছাড়া অন্য কোন উৎসের কারণে থায়রয়েড হরমোনের আধিক্য।
চ) টিএসএইচজনিত (TSH related)
ছ) ফলিকুলার ক্যান্সার (Follicular cancer) ও অন্যান্য।
হাইপার-থায়রয়েডডজমের চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথায়রয়েড ওষুধ। যেটি থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে কমিয়ে দেবে। ওষুধ ব্যতিরেকে কখনো কখনো সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। যখন অ্যান্টি থায়রয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হয়, এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই বছর ব্যবহার করা হয়। তারপর এ ওষুধ তাকে বন্ধ করে দিতে হবে। রোগী যদি স্বাভাবিক থাকে, খুব ভালো কথা, তবে যদি আবারও রোগ ফিরে আসে তবে সাধারণত রেডিও আয়োডিন দিয়ে গ্লান্ড নষ্ট করে দিতে হয়।
থায়রয়েড গ্লান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথায়রয়ডিজম (Hypothyroidism)
হাইপোথায়রয়েডডজম মূলত নিম্নলিখিত কারণে দেখা যায়। যেসব অঞ্চলে আয়োডিনের অভাব রয়েছে, সেখানে আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে হাইপোথায়রয়েডজম দেখা যায়। এছাড়া অটোইমিউন হাইপোথাইরয়ডিজম এ থায়রয়েড গ্লান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে গ্লান্ড নষ্ট হয়ে যায় এবং থায়রয়েড গ্লান্ড কাজ করে না। চিকিৎসাজনিত কারণেও এই অসুখ হতে পারে। অপারেশনের কারণে থায়রয়েড গ্লান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থায়রয়েড নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা হতে পারে। হাইপারথায়রয়েডজমের ওষুধের ডোজ বেশি হলে তার থেকে হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে। নবজাতক শিশুদের মধ্যে থায়রয়েড গ্লান্ড তৈরি বা কার্যকর না হলে কনজেনিটাল হাইপোথায়রয়েডডজম (Congenital Hypothyroidism) দেখা যায়।
হাইপোথায়রয়েডিজমের যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়-
– অবসাদগ্রস্ত হওয়া, সাথে অলসতা, ঘুম-ঘুম ভাব।
– ত্বক খসখসে হয়ে যায়।
– করীর অল্প ফুলে যায়।
– ক্ষুধা মন্দা শুরু হয়।
– চুল পড়তে শুরু করে।
– ওজন অল্প বেড়ে যায়, ৫-৬ কিলো বেড়ে যেতে পারে।
– স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
– শীত শীত ভাব দেখা যায়।
– কোষ্ঠকাঠিন্য শুরু হয়।
– মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
– ব্লাড প্রেশার বাড়তে পারে।
– মাসিকের সমস্যা হতে পারে।
– বন্ধ্যত্ব ও সমস্যা হতে পারে।
– গর্ভধারণকালে গর্ভপাত হতে পারে।
– কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়ডিজমে শিশুর ব্রেণের বিকাশ হয় না।
থায়রয়েড ক্যান্সার (Thyroid cancer)
থায়রয়েড গ্রন্থির কোনো অংশ টিউমারের মতো ফুলে উঠলে বলা হয় থায়রয়েড নেডিউল। এসব থায়রয়েড নেডিউলের ১ শতাংশ থেকে থায়রয়েড ক্যান্সার হতে পারে। থায়রয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থায়রয়েড ক্যান্সার বলে।