খবর৭১ঃ
৫০ বছরের পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বিদেশিদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল এক তলাবিহীন ঝুঁড়ি। আর এখন সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। যে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানই এখন আর্থ-সামাজিক প্রায় সব সূচকেই পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের চেয়ে। দিনে দিনে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পালটে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো।
এটা আরোপিতভাবে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল এক সময়ে এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। এখন আর আমাদের অর্থনীতিতে কৃষির একচ্ছত্র দাপট নেই আগের মতো। নানা চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় ও আয়ু, নবজাত ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশ মাছ, সবজি, ফল, মুরগি, ডিম উত্পাদনে বিশ্ব পর্যায়ে পণ্য হচ্ছে। এর কোনো কোনোটিতে আমাদের অগ্রগতি বিশ্ব পর্যায়ে তৃতীয়-চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। আবার করোনার দুঃসময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও বেড়েছে।
একসময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছিল বিশ্বব্যাংক। ঐ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল, ৭০-এর দশকের বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিচিত্র। যেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পালটেছে। ক্রমশ শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে। সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এদেশের অর্থনীতির আকার ছিল অনেক ছোট। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক পালাবদল ঘটেছে। নানা চড়াই-উতরাই ধাপ অতিক্রম করে বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি একটি ভালো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের নানা দিক বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয়ই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তা হলো আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশেও একটি ছোট-খাটো শিল্প বিপ্লব হয়েছে। এখানে শিল্প খাতের অবদান কয়েক গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যেই নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া অনেকটাই জোরদার হয়েছে। ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। দিনে দিনে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনিভাবে ব্যাংকের গ্রাহকের সংখ্যাও বেড়েছে। ব্যাংকের গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চমত্কার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অতীতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেবার পরিধি শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি আগ্রহ ও তৎপরতায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকাতেও শাখা স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থিক সেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছে আরো অনেক আগে থেকে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো শাখা খোলার পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে তাদের আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসতে বেশ তত্পর হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নানা বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ব্যাংকিং খাত আরো সামনে সমৃদ্ধ অবস্থানে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলার। ১৯৭২ সালে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। ৫০ বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে পাকিস্তানে বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১১৩০ ডলার। পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মাথাপিছু আয় এখন আমাদের। উন্নত দেশ হতে কাজ চলছে ১০ মেগা প্রকল্পের উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে এখন বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। এরপর মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। এখন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নত দেশ হওয়ার। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের মহাসড়কে নিতে কাজ চলছে মেগা প্রকল্পের। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে চাইছে। সরকারের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রণীত নতুন শিল্পনীতিতে সরকার ৩২টি খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বাছাই করেছে। এই খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—পোশাক খাতের সংযোগশিল্প, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ ও ওষুধের উপাদান, তথ্যপ্রযুক্তি হালকা প্রকৌশল ও যানবাহন তৈরি, চামড়া ও পাদুকা, কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং প্লাস্টিক। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিনিয়োগ বাড়ানো। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়া আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি আশা করা যায় না। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে—কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। এলডিসি থেকে বের হলে অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। তখন অনেক বিনিয়োগ আসবে। বিনিয়োগ বাড়লে রপ্তানি কমবে না, বরং বাড়বে। সব মিলিয়ে বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে বাংলাদেশ আরো সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে ক্রমেই।