খবর ৭১: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে নারীদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাজিল করেছেন। সেটি হলো ‘সূরা নিসা’ অর্থাৎ নারীদের সূরা। এই সূরায় নারীদের অধিকার বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন কর। অতঃপর তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা এরূপ জিনিসকে অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।’ (সূরা নিসা : ১৯)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নারীরা তোমাদের আবরণ, আর তোমরাও তোমাদের নারীদের আবরণ।’ (সূরা বাকারা : ১৮৭)।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে পুরুষদের ওপর, যেমন পুরুষদের আছে তাদের (নারীদের) ওপর।’ (সূরা বাকারা : ২২৮)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নেক আমল যেই করবে সে পুরুষ হোক বা নারী যদি সে ঈমানদার হয় তাহলে অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর আমি তাদেরকে তাদের সৎ কর্মগুলোর বিনিময়ে উত্তম প্রতিদান দান করব।’ (সূরা নাহল : ৯৭)
ইসলাম আসার পূর্বে সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতে কন্যা সন্তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলার জন্য সকলে আয়োজনে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে উঠতো এবং এই কন্যা সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত প্রোথিত করাকেই নিজেদের জন্য সম্মান, মর্যাদা ও পুন্যের কাজ বলে মনে করতো। জাহেলী যুগের সেই সময়কার ভয়বহ এই অবস্থার কথা তুলে ধরে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ. يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا
يَحْكُمُونَ
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। আপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!” (সূরা নাহল: আয়াত ৫৮, ৫৯)
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়ছে- ‘পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ, আর নারী যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ।’ (সূরা নিসা : ৩২)। এসব আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, ইসলাম নারীর অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার।
বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর সম্মতি গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করেছে। নারীর অমতে জবরদস্তি করে বিয়ে নাজায়েজ ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে ঠিক করার সময় আগে মেয়ের মতামত গ্রহণ করে নিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কন্যা সন্তান ফাতেমাকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, কোথাও যাওয়ার আগে এবং ফিরে আসার পরে সর্বপ্রথম ফাতিমা (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। নারীর সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে দেনমোহর প্রদান পুরুষের ওপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ সংসারের সার্বিক ব্যয় বহন পুরুষেরই দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নারীদের সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর প্রদান কর, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয় তাহলে তোমরা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে গ্রহণ কর।’ (সূরা নিসা : ৪)
নারী জাতির সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হন একজন মা। ইসলাম মায়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করল- হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলা তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা।’ (বুখারি : ৫৫৪৬)। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’
ইসলাম পর্দার বিধানের মাধ্যমে নারীকে আবদ্ধ করেনি। বরং নারীর মান, ইজ্জত ও জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেছে। কোনো নারীর মাঝে আত্মিক ও বাহ্যিক পর্দা বিদ্যমান থাকলে কেউ তার মর্যাদা বিনষ্ট করতে পারে না। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের অংশের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে, নারীর অংশ দ্বারা পুরুষের অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুই কন্যার অংশ পরিমাণ এক পুত্রের অংশ।’ (সূরা নিসা : ১১)।
আয়াতে এভাবে বলা হয়নি যে, ‘এক পুত্রের অংশের পরিমাণ দুই কন্যার অংশ।’ এতেও অনুমিত হয়, নারীর প্রতি কী পরিমাণ শ্রদ্ধাপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে ইসলামের। কেউ ভাবতে পারেন- পুরুষকে দুই অংশ আর নারীকে এক অংশ দিয়ে তার প্রতি ন্যায়বিচার করা হলো কীভাবে? তাদের প্রশ্নের সুন্দর সমাধান ইসলাম এভাবে দিয়েছে যে- নারী কেবল বাবার সম্পত্তিতেই নয়, তার স্বামী ও সন্তানের সম্পত্তিতেও ভাগ পাবে।
জন্মগ্রহণের পরই একজন নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব তার বাবার, বাবা মারা গেলে বড় ভাইয়ের (যদি থাকে)। বিয়ের পর স্বামীর। বৃদ্ধকালে সন্তানের। পক্ষান্তরে পুরুষকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজে ইনকাম করে চলতে বলা হয়েছে। এমনকি স্ত্রীর উপার্জিত সম্পত্তিতে স্বামীর ন্যূনতম অধিকার থাকে না। এ বিবেচনায় ইসলাম নারীর প্রতি কেবল সমতা নয়; বরং বেশিই দিয়েছে। নারীর এই প্রাপ্ত অধিকার সমাজে বাস্তবায়ন করা সবার দায়িত্ব। আল্লাহ নারীদের অধিকার আদায়ে সহায় হোন।
নারীদের তালিম তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আছে, ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)।’ হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞানার্জন করা) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ (কর্তব্য)।’ (উম্মুস সহিহাঈন-ইবনে মাজাহ শরিফ)। তাই হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২১০, যা সব সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।