শেখ কাজিম উদ্দিন, বেনাপোল প্রতিনিধি :: বেনাপোলের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী ব্রম্ম হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রমটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা লীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর এখানে হরিদাস ঠাকুরের জীবনী, ভাগবত আলোচনা, কীর্ত্তন, নির্যান লীলা, আস্বাদন, ভক্তিগীতি ও পদাবলী কীর্ত্তনসহ নির্যানতিথী মহৌৎসব পালিত হয়। দেশের ৬৪টি জেলাসহ দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো ভক্তের আগমন ঘটে এই আশ্রমে।
যশোহর জেলার বেনাপোল স্থলবন্দরের একেবারে সন্নিকটে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আশ্রমটির ভিতরে রয়েছে নিতাই গৌর মন্দির। যা ৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে টাকি নিবাসি জমিদার শ্রী সুর্যকান্ত রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন। এ জাইগায় রয়েছে ৫৭০ বছরের প্রাচীন মাধবি লতা আর বিরল তমাল বৃক্ষ। আর এই তমাল বৃক্ষের ছায়াতলে শ্রী শ্রী ব্রম্ম হরিদাস দিনে ৩ লক্ষবার নাম জপ করতেন। এখানে গড়ে উঠেছে হরিদাস ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত তীর্থস্থান।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা লীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আর দর্শনীয় স্থান বলতেই মানুষ এ জাইগাটি চেনেন। প্রতিবছর বিশেষ বিশেষ দিনে ধর্মীয় উৎসবে হাজার হাজার দেশী বিদেশী ভক্তদের সমাগম হয় এখানে। এছাড়া এ তীর্থ স্থানটিতে গড়ে ওঠা প্রাচীন মন্দির, মাধবীলতা আর তমাল বৃক্ষ দেখতে প্রতিদিনই আসেন সকল ধর্মাবলম্বীর দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি প্রাচীন এ গৌর মন্দীরটির পাশে নতুন আরেকটি মন্দির তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে আশ্রম পরচিালনা পর্ষদ নিতাই গৌর মন্দিরটি ভেঙে আধুনিকায়নের ঘোষণা দেওয়ায় ফুসে উঠেছে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ। নামাচার্য শ্রী শ্রী ব্রম্ম হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রম রক্ষা কমিটি নামে একটি কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তাদের দাবি, মন্দিরটির নিচে কোন গুপ্তধনের আশায় আশ্রমটি ভেঙে ফেলছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। যা ৫৭০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে আসছে। যেকারণে আশ্রমটি বাঁচিয়ে আধুনিকায়নের আকুতি জানিয়েছেন তারা। মন্দিরটি রক্ষায় আইনী সহয়তা চেয়ে ইতিমধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরেরও দারস্থ্য হয়েছেন। বলেছেন, এ মন্দিরের সাথে রয়েছে ধর্মীয় গুরু ও পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত। তবে মন্দির পরিচালনা পরিষদের দাবী মন্দিরের নতুন ভবন আধুনিকায়নে পুরানো মন্দিরটি বাধ্য হয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মন্দির এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান, মন্দিরটির সাথে স্থানীয়দের অনেক স্মৃতি বিজড়িত। মন্দিরটি এখনো অনেক মজবুত। সংস্কার করলে বহুদিন টিকবে। এটাকে বাঁচিয়ে নতুন ভবনের উন্নয়ন কাজ করলে ভাল হতো। যখন ভাবি এটা থাকছেনা তখন মনে হয় মহাপুরুষ আর পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন, ধুলো মাখা শৈশব-কৈশর বিলিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করবো, আমাদের মত সাধারনের মতামতের তো কোন মুল্য নেই।
স্থানীয়রা আরো জানান, এটা হিন্দু মুসলিমসহ সকল অসাম্প্রদায়িক মানুষের মিলন স্থল। বাইরে থেকে কোন অতিথি আসলে তাদেরকে স্থানীয়রা পাটবাড়ি আশ্রমের ঐতিহ্য দেখাতে নিয়ে যায়। এখান থেকে যদি পূরানো ঐতিহ্য বিলিন হয়ে যায় তবে দর্শনার্থীদের বেনাপোলের প্রতি আগ্রহ কমবে। পুরানো মন্দির বাঁচিয়ে উন্নয়ন কাজ করার আহবান জানান তারা।
বেনাপোল পাটবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সত্যজিৎ রায় বলেন, আমরা বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি, নিতাই গৌর মন্দিরটি দীর্ঘদিনের হওয়ায় এখানে কোন গুপ্তধন থাকতে পারে। যা সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে পুরাতন ভবনটি সংরক্ষণ করণসহ বেনাপোল পাটবাড়ি আশ্রমের ঐতিহ্য রক্ষা ও বেনাপোলের ইতিহাস রক্ষা করা যায়। বলেন, পাটবাড়ী আশ্রমে উৎসবের সময় দর্শনার্থী ও ভক্তদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঘটে হিন্দু-মুসলিমসহ অনেক জাতির মিলন মেলা। এখানে হিন্দু-মুসলমান বা অন্য ধর্মের কোন ভেদাভেদ থাকে না।
নামাচার্য শ্রী শ্রী ব্রম্ম হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রম রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অশোক কুমার দে বলেন, বেনাপোল পাটবাড়ি আশ্রমটি সোনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উপাসনালয়। যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত। যেখানে প্রাচীন নিদর্শণগুলি রক্ষার জন্য সরকার অনুদান অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক মাধ্যমে জানতে পারলাম ৫৭০ বছরের মন্দিরটি ও মন্দিরের ভিতর থাকা বিগ্রহ এবং নিতাই গৌর সেবাকুঞ্জ অপসারণ করার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মবলম্বীদের প্রাচীন প্রার্থনার স্থান মন্দিরটি ও মন্দিরের ভিতরে থাকা বিগ্রহ এবং নিতাই গৌর সেবাকুঞ্জ অপসারণ করা না হয় সেজন্য তারা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অবহিত করেছেন।
বেনাপোল সীমান্তের ছোট আঁচড়া মন্দিরের পুরহিত শ্রী শ্রী শ্যামা পতা জিও বলেন, আমরাও আধুনিকায়নের পক্ষ্যে। তবে পুরানো ইতিহাস, ঐতিহ্য ধ্বংস করে নয়। সরকার যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করছে। তখন এ অ লের সবচেয়ে বড় স্মৃতি বিজড়িত এমন একটি ধর্মস্থান ভাঙা পড়ছে। এটাকে বাঁচানো সম্ভব হলে ভাল হতো।
বেনাপোল পাটবাড়ি মন্দির কমিটির সাধারন সম্পাদক ফনীভূষণ পাল বলেন, পুরানো মন্দির ভাঙার সিদ্ধান্ত কারো ব্যক্তিগত না। অনেক অবিভাবকদের সাথে পরামর্শ করে উন্নয়ন কাজের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন নকসায় পুরানো মন্দিরের পাশে যে নতুন মন্দিরের ভবন তৈরী হচ্ছে সেখানে মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন করতে এছাড়া বিকল্পপথ তারা দেখছেন না। যেহেতু কিছু মানুষের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে এলজিআরডি মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টচার্য বেনাপোলে আসবেন তখন বিষয়টি নিয়ে আবারো আলোচনা হবে।
বেনাপোল পাটবাড়ি মন্দির কমিটির সভাপতি তাপস বিশ্বাস বলেন, মন্দিরটি অনেক পুরানো ও জরাজীর্ণ। দেশ ডিজিটাল হতে সবখানে উন্নয়ন কাজ চলছে। তাই এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে ভাঙা পড়ছে শুধু পুরানো মন্দিরটি। অনান্ন্য স্থাপনা বা প্রাচীন বৃক্ষের কোন ক্ষতি হচ্ছেনা।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পুলক কুমার মন্ডল জানান, মন্দিরের সুবিধা-অসুবিধা দেখে থাকে মন্দির পরিচালনা কমিটি। তবে স্থানীয় কিছু মানুষ মন্দিরটি রক্ষায় আবেদন করেছেন। সরকারী কাজে ব্যস্ততার কারনে তিনি বিষয়টি এখন পর্যন্ত সেভাবে দেখতে পারেননি। কয়েকদিনের মধ্যে একটি কমিটি করে তদন্ত করে দেখবেন।
শেখ কাজিম উদ্দিন
বেনাপোল, যশোর
০১৭১১৩৮৭৪৫৯, ০১৯১১৯৭০৭৩৮।