খবর৭১ঃ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ৯ মাস থেকে ১ বছরের সেশনজট সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই জটের ধাক্কা সামাল দিতে অন্তত দুই বছর সময় লেগে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে একটি সেমিস্টার পুরোপুরি চলে যেতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা আর আন্তরিকতায় সেশনজটের ধকল কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে না। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি বা এইচএসসি পরীক্ষাও নেয়া হবে না। ফলে শিক্ষাঙ্গন কবে সচল হবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ আগস্টের পর যদি আর ছুটি না-ও বাড়ে, তবু ৫ মাসের ছুটিতে ৯ মাস থেকে ১ বছরের সেশনজট হবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে অক্টোবর-নভেম্বরে নতুন সেমিস্টার শুরু করা যাবে। তবে সাধারণভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে বিদ্যমান সেমিস্টার। কেননা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েই পরীক্ষা নেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে দেড়-দুই মাসের প্রস্তুতির সময় দিতে হবে।
ইউজিসির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার বিদ্যমান ক্ষতি কমিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত দুই বিকল্প ভাবনাই উঠে এসেছে। একটি হচ্ছে- সাধারণ ছুটির আগে নেয়া শ্রেণি কার্যক্রমে শেষ করা কোর্সের ওপর বিশেষ ব্যবস্থায় চলতি সেমিস্টারের পরীক্ষা নিয়ে রাখা। এমনটি করা সম্ভব হলে ছয় মাসের সেশনজট এখানেই কমে যাবে।
এরপর জুলাইয়ে শুরু হওয়া সেমিস্টারের শ্রেণির পাঠদান অনলাইনে নেয়া। এ দুই কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সেশনজট তৈরিই হবে না।
অন্য বিকল্পটি হচ্ছে- এখন পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হলে সেশনজট মেনে নিয়ে দুই বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা করা। সেটি হচ্ছে- যখনই ক্যাম্পাস সচল হবে, তখন থেকে কোর্সের শ্রেণি কার্যক্রম ও ল্যাবরেটরি ওয়ার্ক সাধারণভাবে চলবে। এক্ষেত্রে কোর্সের কিছু ‘টপিক’ (পাঠের বিষয়) বাদ দেয়া যেতে পারে।
এভাবে করা হলে ৬ মাসের সেমিস্টার ৪ মাসে নিয়ে আসা যাবে। সেক্ষেত্রে ৯ মাস থেকে ১ বছরের জট তৈরি হলেও তা ২ বছরে পূরণ করা সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আসলে উচ্চশিক্ষায় হয়ে যাওয়া ক্ষতি রোধে আমরা কোন পরিকল্পনা নিয়ে আগাব, সেটা নির্ধারণ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা। আমাদের অনেক চিন্তাই আছে। কিন্তু আমরা কিছুই চাপিয়ে দেব না। তাদের সঙ্গে আলাপ করব।
নিশ্চয়ই তাদেরও এ নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে। সেটা আমরা শুনব। এজন্য তাদের সঙ্গে বৈঠক ডাকা হয়েছে। ২৫ জুন বিকাল ৩টায় এই ভার্চুয়াল বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সেশনজট যেটা তৈরি হয়েছে, সেটা দূর হবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কতটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করছে তার ওপর। এক্ষেত্রে ‘স্মার্ট’ নেতৃত্ব এবং আন্তরিকতা খুবই দরকার। বিভিন্ন বিকল্প আছে। সেগুলো প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে আমি মনে করি, এই জটের ধকল সামলাতে দুই বছরের পরিকল্পনা প্রয়োজন হবে। দুই বছরের মধ্যে আমরা আবারও সেশনজটমুক্ত উচ্চশিক্ষা পাব।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বর্তমানে দুই ধরনের খাত আছে। একটি পাবলিক, আরেকটি প্রাইভেট। ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরীক্ষা ও ক্লাস নেয়ার অনুমতি দিয়েছে ইউজিসি। দেশে সক্রিয় ৯৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮৫টি তিন উপায়ে পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি পেয়েছে। তবে প্রত্যেক উপায়েই এই মুহূর্তে ল্যাবরেটরিভিত্তিক ব্যবহারিক পরীক্ষা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিতে হবে এই পরীক্ষা।
আর কেউ মহামারীকালের কারণে পরীক্ষা দিতে না পারলে বিনা জরিমানায় পরে পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে জুলাই থেকে পরবর্তী সেমিস্টারে ক্লাস শুরুর অনুমতিও দেয়া হয়েছে। এই ক্লাস নিতে হবে অনলাইনে। অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের উপায় ইউজিসিকে জানিয়ে পূর্বানুমতি নিতে হবে। এই অনুমতি দেয়ার আগে ৩০ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে ভিসিদের নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছিল।
অপরদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিইউপি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অনলাইনে শতভাগ কার্যক্রম চালাচ্ছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তেমন সাড়া মিলছে না।
মূলত মহামারীকালে শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক অবস্থা, অনলাইন ক্লাসের জন্য সামগ্রীর সংকটসহ অন্যান্য কারণে এমনটি হয়েছে। এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে অনীহাও অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে ইউজিসি অনলাইন কার্যক্রমের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, সমীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশের স্মার্টফোন আছে। ৫৫ শতাংশের ল্যাপটপ আছে। অপরদিকে সব শিক্ষকের ল্যাপটপ আছে। কিন্তু ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট খরচ, দুর্বল নেটওয়ার্কসহ বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস করার উপযোগী ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আর ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, অনলাইনে ক্লাসরুম সত্যিকার ক্লাসরুমের মতো নয়। ৭২টি প্রশ্নের এই সমীক্ষায় ১৫ দিনে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ও ৭০০ শিক্ষক অংশ নেন। অনলাইনে ক্লাস চালু করতে ‘বিডিরেন’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটওয়ার্কের সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, সেমিস্টার রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা দিতে তারা রাজি। তবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির দেড়-দুই মাস সময় দিতে হবে। এরপর অনলাইনে ক্লাস নিলে হয়তো অনেকেই অংশ নিতে পারবেন। কেননা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে ইন্টারনেটের গতিশীলতা এবং দাম। ইতোমধ্যে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ টিউশন বা পার্টটাইম চাকরি করে লেখাপড়া করে। করোনাকালে সেসব আয় বন্ধ আছে। তাই ইন্টারনেটের দাম কমানো জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ডিভাইস সরবরাহ করা সম্ভব হলে খুব ভালো হয়।
এ প্রসঙ্গে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অনলাইন ক্লাসে আমাদের উপস্থিতি প্রায় ৮৫ শতাংশ। এটা ঠিক যে, ঠেলাওয়ালা, কুলিসহ দিনমজুরের সন্তানও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই আর্থিকভাবে সবাই সক্ষম তা নয়।
তাই ইন্টারনেটের দাম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য সম্ভব হলে কমানো জরুরি। এটাকে উচ্চশিক্ষায় সরকারের প্রণোদনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, অনলাইন শিক্ষা কখনোই ক্যাম্পাসভিত্তিক সনাতনী উচ্চশিক্ষার বিকল্প নয়। বিশেষ সময়ে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে এটা গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটসহ অন্যান্য সুবিধা-অসুবিধা দূর করার পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, তবে এটা ঠিক যে, এই করোনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে উচ্চশিক্ষার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় ফিরতে পারবে কি না সন্দেহ। কেননা অনেকেই পার্টটাইম চাকরি হারিয়েছেন। করোনার কারণে অনেকে টিউশন আর ফেরত না-ও পেতে পারেন। এ ধরনের শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ফিরে কী খাবেন আর কীভাবে চলবেন। তাই এ বিষয়টি ভাবনার পাশাপাশি সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন।