খবর৭১ঃ বিশাল হলঘর। চারদিকে রঙের বাহার। লাল, নীল আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে যেত। আধুনিক সব মেশিনপত্রে ঠাসা ছিল হলরুম। এটা কোনো সিনেমার শুটিং দৃশ্য নয়। বাস্তবেই দেখা যেত আরামবাগ ক্লাবে। আধুনিক সব জুয়ার মেশিনে ঠাসা ছিল ক্লাবঘর। ক্রীড়া ক্লাবে ক্রীড়াটাই ছিল না। খেলোয়াড়দের থাকার ঘরও দখল করে নিয়েছিল ক্যাসিনো।
শুধু জুয়াই নয়, মদ, গাঁজার সঙ্গে ইয়াবারও হাতবদল হতো এখানে। কোটি কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হতো ক্যাসিনোর আড়ালে। সেই সঙ্গে ছিল নারীঘটিত অসামাজিক কার্যকলাপ। আর এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক একেএম মুমিনুল হক সাঈদ। কথিত আছে, প্রতি রাতে আরামবাগ ক্লাবে প্রায় কোটি টাকা ক্যাসিনো, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে হাতবদল হতো। অথচ আরামবাগ ক্লাবের ইতিহাস-ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
এলাকার উচ্ছল ছেলেরা পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে নটর ডেম কলেজ মাঠে ফুটবলে মেতে উঠত। সেই আনন্দ-উদ্দীপনা থেকেই ১৯৫৮ সালে এলাকার নামে গঠিত হয় ‘আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ’। মোস্তফা জামান বেবী ছিলেন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সেসময়ে হাসান, মন্টু, হাজী কাসেমরা ক্লাব গঠনে নিরলস কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আমান আহমেদ চৌধুরী।
ক্লাব ঘর না থাকায় কার্যক্রম চলত মোস্তফা জামান বেবীর বাসায়। প্রথম বছরেই তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে নাম লেখায় আরামবাগ। শুরু হয় ক্লাবের যাত্রা। প্রায় এক দশক যাযাবর থাকার পর নিজস্ব জায়গা খুঁজে পায় আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ। নটর ডেম কলেজের পেছনে গড়ে তোলে নিজস্ব ক্লাবঘর। একই বছরে দ্বিতীয় বিভাগে ওঠে ক্লাবটি। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। ১৯৮০ সালে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় স্থায়ী ঠিকানা হয় আরামবাগের।
প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগ কখনও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সব সময় একটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল দলটি। ২০১৭-১৮ মৌসুমে স্বাধীনতা কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ফেডারেশন কাপে ১৯৯৭, ২০০১ ও ২০১৬ সালে তিনবার রানার্সআপ ট্রফি শোভা পাচ্ছে আরামবাগের শোকেসে। ১৯৮১ সালে নেপালের আনফা কাপে রানার্সআপ হওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে দলটির। ১৯৯৫ ও ২০০১ সালে সিকিম গভর্নরস কাপ এবং ২০০১ সালে ভুটানে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আরামবাগ।
অনেক দেশসেরা খেলোয়াড় সৃষ্টি হয়েছিল এই ক্লাব থেকে। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আলফাজ আহমেদ, আবু ফয়সাল আহমেদ, ফিরোজ মাহমুদ টিটু, আরমান মিয়া, রকিব মেহবুব আপেল, মিজানুর রহমান ডন, মোহাম্মদ শোয়েব, বিজন বড়ুয়া, আসিফ, প্রদীপ পোদ্দার, বিদ্যুৎ, তুষার, মাহবুব হোসেন রক্সির মতো প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় আরামবাগের হয়েই খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন। অতীতে এ ক্লাবের হয়ে নাম কুড়িয়েছিলেন শফিকুল ইসলাম মানিক, আহমেদ ও সালাহউদ্দিন কালারা। শুরুতে ক্লাবটি ফুটবল খেললেও হ্যান্ডবলে বেশ নামডাক করেছে তারা।
নারী হ্যান্ডবলে হ্যাটট্রিক শিরোপাও জিতেছিল আরামবাগ। একবার রানার্সআপ। আরামবাগ ক্লাব গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন মোস্তফা জামান বেবী। তেমনি ক্লাবটিকে মর্যাদার আসনে আনার পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল বাফুফের ও এই ক্লাবের সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান টিটুর। ১৩ বছর আরামবাগের সভাপতি ছিলেন এসএ সুলতান।
খেলাধুলার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধেও আরামবাগের অবদান রয়েছে। ফুটবলার আলম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ফোরকান, আলমগীর, আবদুস সালাম (বিএনপি নেতা ও অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি), মোস্তফা জামান বেবী, আবুল কাসেম, মহিউদ্দিন, হাসান, মন্টু।
অথচ এত সব কৃতিত্বের অধিকারী ক্লাবটিকে জুয়া ও মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছে বর্তমান নেতৃত্ব। মুমিনুল হক সাঈদ কাউন্সিলর হয়েই ক্লাবের সভাপতির পদটি দখল করে নিয়েছেন। ক্যাসিনো বসিয়ে মদ ও জুয়ার আখড়ায় পরিণত করেছিল আরামবাগ ক্লাবটিকে। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারতেন না।
শুধু ক্লাবের সভাপতির পদ দখল করেই সাঈদ ক্ষান্ত হননি, পাশের দিলকুশা ক্লাবটিও করায়ত্ত করেছেন এই যুবলীগ নেতা। কোটি কোটি টাকা বিলিয়ে হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদেও নির্বাচিত হয়েছেন সাঈদ। শুধু কাউন্সিলরদেরই নয়, যুবলীগের এক গডফাদারকেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন এই কাউন্সিলর। সূত্র জানায়, ক্রীড়া সাংবাদিকদের একটি অংশকেও পুষতেন মুমিনুল হক সাঈদ।
অন্যদিকে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ভিক্টোরিয়া ক্লাবও। ষাটের দশকে এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভিক্টোরিয়া ছিল একটি উজ্জ্বল নাম। ১৯০৩ সালে পল্টন ময়দানে যে অংশে হকি স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে তার ঠিক মাঝামাঝি ছিল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের টেন্ট। ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাব ঘরের দক্ষিণ পার্শ্বে ছিল টেনিসের লন।
সেই সময়কার আভিজাত্যের কুলীনতা ছিল তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলার জমিদার বাবু সুরেশ চন্দ্র ধাম, বলধার জমিদারের একমাত্র সন্তান বাবু নৃপেন রায় চৌধুরী, মুড়াপাড়ার জমিদার রায় বাহাদুর কেশব চন্দ্র ব্যানার্জী, জমিদার দিনেশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও মালখা নগরের বোস পরিবারের বাবু সুনিল কুমার বোস মিলে তৈরি করেছিলেন ভিক্টোরিয়া। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহামেডান ও ওয়ান্ডারার্স বাদে প্রায় সব ক্লাবই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সুরেশ চন্দ্র ধামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শাহাদত, ননী গোপাল, ফরিদ, শামসুদ্দিন ও আবদুল ওদুদ চৌধুরী নতুন ক্লাব গঠন করেন। প্রাণ ফিরে পায় ভিক্টোরিয়া।
শুরুতে ভিক্টোরিয়া ক্লাব ছিল গুলিস্তানের উত্তর দিকে। পরবর্তী সময়ে সেখানে গুলিস্তান সিনেমা হল ও জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) নিয়ে বাণিজ্যিক এলাকা সম্প্রসারণের কারণে ১৯৫১ সালের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়া ক্লাবকে বর্তমান ঢাকা স্টেডিয়ামের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে স্থানান্তর করা হয়। তারপর সময়ের হাত ধরে বেশ কয়েকবার ক্লাব ঘরকে জায়গা বদলাতে হয়েছে। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়া ক্লাবকে সরিয়ে নেয়া হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে।
১৯৬৮ সালে ভিক্টোরিয়া ক্লাবকে আবার সরতে হয়। এবার তারা ’৫২ সালের আগের জায়গায় নতুন করে টেন্ট তৈরি করে। এ সময় তাদের নিজস্ব টেনিস লন ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছিল। ’৯১ সালে আবার সরাতে হয় ক্লাব টেন্ট। এটাই ছিল তাদের শেষ জায়গা বদল। মতিঝিলের ঝিল ভরাট করা জমিতে নিয়ে আসা হয় তাদের। যে ক্লাবে ১৯০৩ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিজেদের মাঠ, টেনিস লন, ব্যাডমিন্টন কোর্ট সবই ছিল, এখন আছে ক্যাসিনো আর জুয়ার বোর্ড।
যদিও ক্লাব কর্মকর্তাদের দাবি, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের হুমকির মুখে ক্যাসিনোর জন্য ভাড়া দিতে হয়েছিল। প্রতিদিন ৪০ হাজার টাকা করে ভাড়া আসত ক্লাবে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাসিনোমুক্ত করে ক্লাব দুটিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। অন্তঃপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকদের আশা, ক্যাসিনো পরবর্তী ক্লাবপাড়া থেকে মদ, জুয়া দূর হয়ে ক্রীড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে।