খবর৭১ঃ চলমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানের মধ্যেও যুবলীগে পদায়ন থেমে নেই। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী। মিরপুরের সবাই তাকে বাপ্পী নামেই চেনে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসকে ৬০ লাখ টাকা দিয়ে বাপ্পী এই পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও বাপ্পীর দাবি, সংগঠনের প্রতি তার অবদান দেখে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দিয়েছেন।
মিরপুরের যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাপ্পীর বাবা নজরুল ইসলাম চৌধুরী মন্টু প্রভাবশালী ঝুট ব্যবসায়ী ছিলেন। এ ব্যবসায় একচ্ছত্র দাপটের কারণে মিরপুর এলাকায় তিনি পরিচিত ছিলেন ঝুট মন্টু নামে। ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর দলের হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল ঝুট মন্টুর। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তার আর প্রার্থী হওয়া হয়নি। প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ওই সময়ই। মূলত বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরে দৃশ্যপটে আসেন বাপ্পী। ওয়ার্ড যুবলীগে যোগ দেন প্রথমে, এর পর ওয়ার্ড থেকে পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি হন। ওই সময় আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা, যিনি আগে যুবলীগের শীর্ষ পদের নেতৃত্বে ছিলেন তার আস্থা অর্জনে সক্ষম হন বাপ্পী চৌধুরী। এর পর আর পেছন ফিরে থাকাতে হয়নি। যুবলীগের পদের প্রভাব খাটিয়ে মিরপুর-পল্লবী এলাকার ঝুট ব্যবসা থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণ, বস্তি নিয়ন্ত্রণ, মার্কেটে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে প্রায় সব অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন কাঁচা টাকা আদায়ের কারণে অল্প সময়েই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। এখন চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে সামনে পেছনে বিশাল মোটরসাইকেল বহর নিয়ে।
মিরপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাপ্পী মূলত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী রজ্জবের লোক। তাকে শেল্টার দেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রেখেছেন।
বাপ্পীর পদপ্রাপ্তির বিষয়ে যুবলীগের দপ্তর সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিলের আলোচিত রিয়াজুল আহমেদ মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর দেশ ছেড়ে পালান ওই মামলার অন্যতম আসামি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনায়েত কবির চঞ্চল। পরে চঞ্চলকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। চঞ্চলের ওই শূন্যপদ পেতে অনেকেই চেষ্টা-তদবির চালিয়েছেন। কিন্তু টাকার জোরে বাকি সবাইকে হটিয়ে পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন বাপ্পী চৌধুরী। এ জন্য দুই দফায় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসের মাধ্যমে যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রথমে বছরখানেক আগে আনিসকে ৪০ লাখ টাকা দেন। এর পর থেকে পদটির জন্য তিনি ধরনা দেওয়া শুরু করেন। তাতেও কাজ না হলে সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে আবার ২০ লাখ টাকা দেন। এর পর তাকে পল্লবী থানা থেকে মহানগর উত্তর যুবলীগের শীর্ষ পদে পদায়ন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনায়েত কবির চঞ্চল গতকাল রাতে আমেরিকা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বলেন, আমাকে সংগঠনের পদে থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে সেটা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে আমার পদে আরেকজনকে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার সংগঠনের গঠনতন্ত্রে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি যতদূর বুঝি, সম্মেলন ছাড়া এভাবে পদ দিতে পারেন না কেউ। আর আমি মামলায় জামিনে আছি এখনো, আদালত এখনো অভিযুক্ত বলেনি। তাই এভাবে আমার পদে আরেকজনকে বসিয়ে দেওয়া ঠিক না।
যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও ইসমাইল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি থেকে দেখা যায়, ‘যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাপ্পী চৌধুরীকে যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদায়ন করা হয়।’ গত ২০ সেপ্টেম্বর চিঠিতে স্বাক্ষর করেন উত্তর যুবলীগের দুই শীর্ষ নেতা নিখিল ও ইসমাইল। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় চার মাস আগেই বাপ্পীকে উত্তর যুবলীগের পদ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে মহানগর উত্তরকে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় যুবলীগ। সেই চিঠি অনুযায়ীই চার মাস পরে গত সপ্তায় পদ পান বাপ্পী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশে বাপ্পী চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদায়ন করা হয়েছে। এখানে আমাদের বলার কিছু ছিল না।
একাধিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাপ্পী চৌধুরী গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, পদের জন্য আমি কেন্দ্রে টাকা দিলে কেন্দ্র থেকে পদ দিত আমাকে। কিন্তু আমাকে তো পদ দিয়েছে যুবলীগ মহানগর উত্তর। ঝুট ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, ওটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। বাবা মারা যাওয়ার পর এই ব্যবসার হাল ধরি আমি।
তিনি আরও বলেন, শুধু আমি না, মিরপুর এলাকার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী প্রায় সব নেতাই ঝুট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এটা নতুন কিছু নয়। চাঁদাবাজি এবং মার্কেট ও বস্তি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, যুবলীগের শূন্য পদটার জন্য অনেকেই কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েছেন। আমি নিজে এক বছর ধরে যুবলীগ চেয়ারম্যান, দপ্তর সম্পাদক, উত্তরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে দাবি করে আসছিলাম। তারা একপর্যায়ে আমাকে পদটি দিয়েছেন। যুবলীগের সব কর্মসূচিতে আমি প্রচুর নেতাকর্মী নিয়ে উপস্থিত হই। সে কারণে যুবলীগ চেয়ারম্যান উপহার হিসেবে আমাকে পদটি দিয়েছেন। প্রতিপক্ষ যারা পদটি চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি; তারা আমার নামে এসব অভিযোগ ছড়াচ্ছেন।