খবর৭১ঃ
মিথ্যা ঘোষণায় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আনা প্রায় ২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা মূল্যের ‘ভায়াগ্রা’র দুটি বিশাল চালান ধরা পড়েছে। ওষুধের কাঁচামাল ও ফুড ফ্লেভার ঘোষণা দিয়ে আলাদাভাবে ২ হাজার ৭০০ কেজি পাউডার আমদানি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা ২ হাজার ৫০০ কেজি পাউডারের চালানটি রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়। এতে ভায়াগ্রার উপাদান পাওয়া গেছে। ওষুধের কাঁচামাল ঘোষণা দিয়ে ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং ফুড ফ্লেভারের কথা বলে ১৭০ কোটি টাকার ভায়াগ্রার কাঁচামাল আমদানি হয়। বেনাপোল কাস্টমসের হাতে বিশাল চালান আটকের পর কর প্রশাসনে হইচই শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা এ পণ্যে সরকারের শুল্কও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু কর প্রশাসনের খবর পেয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিএন্ডএফ এজেন্ট গা ঢাকা দিয়েছে। এখন বেনাপোল কাস্টমসের হাতে আটক চালান ছাড় করাতে প্রভাবশালীদের কাজে লাগাচ্ছে চক্রটি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শক্ত অবস্থানের কারণে ভায়াগ্রার ওই চালান এখনও গোডাউন থেকে খালাস করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, একদিনেই ২ হাজার ৫০০ কেজি রাসায়নিক পাউডার আটকের পর তাতে ‘ভায়াগ্রার উপাদান’ আছে মর্মে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। এটি নিশ্চিত হতে সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়।
এর মধ্যে সায়েন্স ল্যাব বা বিসিএসআইআর ছাড়া সবকটি দফতরের রাসায়নিক পরীক্ষায় আটককৃত পাউডারে ভায়াগ্রার উপাদান আছে বলে প্রমাণ মেলে। এই বাস্তবতায় সায়েন্স ল্যাবের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ পরীক্ষা ও রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কাস্টমস বিভাগ।
এমনকি ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট পক্ষপাতমূলক করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী ২৭ আগস্ট এনবিআরের চেয়ারম্যান বরাবর এক চিঠিতে এ অনুরোধ করেন। এতে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ ও সব ল্যাবের পরীক্ষার ফল জানিয়ে সায়েন্স ল্যাবের জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
জানা গেছে, ২১ মে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে ২ হাজার ৫০০ কেজি পাউডার ভায়াগ্রার চালান খালাসের চেষ্টা করা হয়। গোপন সূত্রের খবরে বিষয়টি বেনাপোল কাস্টমসের নজরে আসে। ওই চালান খালাসের কয়েক মিনিট আগেই কাস্টম হাউসের আইআরএম টিম তা আটক করে।
সাদা পাউডারের আড়ালে ভায়াগ্রার ওই বিশাল চালানটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আইবি ট্রেডার্স থেকে আমদানি করে ঢাকার মিটফোর্ডের (আমদানিকারক) প্রতিষ্ঠান মেসার্স বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজ। এ প্রতিষ্ঠানের বেনাপোল স্থানীয় সিএন্ডএফ এজেন্ট সাইনী শিপিং সার্ভিসেস। বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজ ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ বা এসএসজি পাউডার ঘোষণা দিয়ে ওই চালানটি ভারত থেকে আমদানি করে। ওষুধ তৈরির উপাদান হিসেবে ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ এই চালানে যে পরিমাণ পাউডার ছিল, বন্দরে তার মূল্য দেখানো হয় ১২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এই চালান বাবদ সরকারকে ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ট্যাক্সও দেয়।
এ পর্যায়ে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে এতে কী আছে, তা নিরূপণের জন্য আমদানিকৃত পাউডারের উপাদান পরীক্ষা করতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), সায়েন্স ল্যাব, কাস্টমসের নিজস্ব ল্যাব ও ড্রাগ প্রশাসনের ল্যাবে সাদা সোডাজাতীয় সেম্পল পাঠায়।
আমদানিকৃত ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেটের’ রাসায়নিক পরীক্ষার পর ২৯ মে, বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, ২৮ জুলাই কুয়েট কর্তৃপক্ষ, ৬ জুলাই ড্রাগ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ, ১৫ জুলাই বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও ৯ জুলাই সায়েন্স ল্যাব কর্তৃপক্ষ সেম্পল পরীক্ষা করে।
এর পরপরই এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তাদের ল্যাব পরীক্ষার রিপোর্ট বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে। এ পর্যায়ে কুয়েট, বেনাপোল কাস্টম ল্যাব ও ড্রাগ প্রশাসনের ল্যাব রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যে নমুনা তারা পরীক্ষা করেছে তাতে ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ বা ভায়াগ্রার উপাদান রয়েছে।
অর্থাৎ বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজ ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ বলে যে বড় চালানটি দেশে আনে, তা মূলত ভায়াগ্রার চালান। অন্যদিকে বুয়েটের ল্যাব টেস্টে ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’-এর ভেতর আর কী উপাদান আছে, তা শনাক্ত করতে পারেনি মর্মে রিপোর্ট দেয়।
রিপোর্টটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পুনরায় সেম্পল পাঠানো হয়। আর সায়েন্স ল্যাবের রিপোর্ট হয়েছে বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজের ঘোষণা মোতাবেক তাদের পক্ষে ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ বলেই।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ল্যাব টেস্টের বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা নিজেদের ল্যাবে পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হয়েছি, এটি ভায়াগ্রার চালান। আরও অধিকতর প্রমাণের জন্য সরকারের অন্যান্য দফতরে সেম্পল পাঠাই।
সায়েন্স ল্যাবের রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক ডা. শাহীন আজিজকে ফোন করলে তিনি ফোনটি রিসিভ করেন। তার কাছে ওই রিপোর্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বাদল বলেন, আমাদের কাছে সাদা পাউডার সেম্পল হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। বেনাপোল কাস্টম হাউসের পাঠানো সেই সেম্পল পরীক্ষা করে তাতে ভায়াগ্রার উপাদান পেয়েছি। সেই রিপোর্ট তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি।
ড্রাগ প্রশাসনের পরিচালক নাইয়ার সুলতানা বলেন, আমাদের কাছে যে নমুনা দেয়া হয়েছিল, তা ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবে পরীক্ষা করে ভায়াগ্রার উপাদান পেয়েছি। আড়াই হাজার কেজি ভায়াগ্রা দেশের ভেতর ঢুকলে কারা লাভবান বা কারা ক্ষতির শিকার হতে পারেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ উপাদানই ভায়াগ্রা। এটি মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি।
এদিকে ২৭ আগস্ট এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর লেখা চিঠিতে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল চৌধুরী জানান, ‘যে পরিমাণ ভায়াগ্রার উপাদান আটক করা হয়েছে, তা বাজারে ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট ফরমেটে বিক্রি হয়।
যে চালানটি (২ হাজার ৫০০ কেজি) আটক করা হয়েছে, তা দিয়ে ১০০ মিলিগ্রামের ২ কোটি ৫০ লাখ ভায়াগ্রা টেবলেট তৈরি সম্ভব। দেশে-বিদেশে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, ১০০ মিলিগ্রামের একটি ট্যাবলেটের মূল্য ১০ ডলার। সে অনুযায়ী চালানটির বাজারমূল্য ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা।
সরকারি অন্য সংস্থার ল্যাব টেস্টে আটক চালানের পরীক্ষায় ভায়াগ্রার উপাদান পেলেও বিসিএসআইআর’র (সায়েন্স ল্যাব) রিপোর্টটি প্রভাবিত ও পক্ষপাতদুষ্ট। কারণ আর কোনো ল্যাবেই পণ্যটি ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ হিসেবে শনাক্ত হয়নি। বিসিএসআইআর যে পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট দিয়েছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার সত্যতাও মিলেছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বর্তমান আমদানি নীতি আদেশের শর্তানুযায়ী প্রায় সব রকমের খাদ্যদ্রব্য বিসিআইআর কর্তৃক পরীক্ষিত হতে হবে। একটি আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে এ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার খাদ্যদ্রব্য ও রাসায়নকি দ্রব্য আমদানি করা হয়।
এসব ক্ষেত্রে বিসিএসআইআর’র রিপোর্টের ওপর জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তসহ শত শত কোটি টাকার রাজস্ব নির্ভর করে। গোপন সংবাদের ভিত্ততে জানা যায়, বিসিএসআইআর’র ওই রিপোর্ট আমদানিকারক চক্র কর্তৃক প্রভাবিত ও পক্ষপাতদুষ্ট।
এ ধরনের অপকর্মে জড়িতরা বিসিএসআইআর’র মতো প্রতিষ্ঠানের সুনাম চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। বৃহত্তর ভায়াগ্রার চালানের রাসায়নিক রিপোর্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। এই রিপোর্ট বিসিএসআইআর’র সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আটককৃত পণ্য খালাসের আগে সংবাদ না পাওয়া গেলে বিসিএসআইআর’র এ ধরনের রিপোর্টের কারণে ২ হাজার ৫০০ কেজি ভায়াগ্রার কাঁচামাল খালাস হয়ে দেশের ভেতর ঢুকে যেত।’
এনবিআর চেয়ারম্যান ছাড়াও ওই চিঠির অনুলিপি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিসিএসআইয়ের চেয়ারম্যান, এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালককে দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে প্রভাবিত ও পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিসিএসআইআর’র সংশ্লিষ্ট ইউনিটে কর্মরতদের সংশ্লিষ্টতা বা সম্পৃক্ততা যাচাই করা দরকার বলেও উল্লেখ করা হয়। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বেনাপোল কাস্টমস আমাদের বিশাল চালানটি আটকে দিয়েছে। তারা সন্দেহ করছে আমরা ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যে চালানটি এনেছি তাতে ভায়াগ্রার উপাদান আছে।
তবে সায়েন্স ল্যাবের রিপোর্টে তা বলা হয়নি। তারপরও কর্তৃপক্ষ যেহেতু ভায়াগ্রা বলছে, তাই আমি পশ্চিমবঙ্গের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আইবি ট্রেডার্সের কাছে চিঠি লিখেছি। তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, পণ্যের চালানে ভায়াগ্রার উপাদান সংবলিত পণ্য দেয়া হয়েছে কি না? আমি ওই চিঠির কপি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকেও দিয়েছি।
‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ কী কাজে ব্যবহার করা হয় জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ (ট্যাবলেট, ক্যাপসুলসহ নানা ওষুধ) তৈরিতে এজাতীয় রাসায়নিক পণ্য লাগে। আমরা তা সরবরাহ করি। তবে চালানটি ভায়াগ্রার কি না, এটা জানি না। চিঠির উত্তর এলে জানা যাবে।
এদিকে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন যে ট্রাকভর্তি আড়াই টন ভায়াগ্রা তড়িঘড়ি করে খালাসের পূর্বমুহূর্তে গোপন সংবাদ পেয়ে জব্দ করি।
বিসিএসআইআরের রিপোর্ট সঠিক ধরে বিধি মোতাবেক শুল্কায়ন করা হয়। আমার অবাক লাগে, বিসিএসআইআর ‘সোডিয়াম স্টারর্স গ্লোকোলেট’ নাম কোথা থেকে পেল! আমাদের চিঠিতে কোথাও এ নাম ছিল না।
তিনি বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি, ভায়াগ্রাও ইয়াবা হয়ে উঠতে পারে। একটা দেশবিরোধী অপরাধী চক্র এর সঙ্গে জড়িত। নানাভাবে চাপ ও প্রভাব খাটিয়ে খালাসের চেষ্টা করছে। জনস্বাস্থ্য ও তরুণসমাজ বিনষ্টকারী এ জঘন্য পণ্য যে কোনো মূল্যে আটকে রাখব। আমি সাড়ে চার হাজার পয়েন্টে রেড অ্যালার্ট পাঠিয়েছি। মিডিয়ায় এর ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরার জন্য অনুরোধ করব। একই সঙ্গে প্রশাসনের সব পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চাই।