খবর৭১ঃ যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী জেলাগুলোয় প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দেশের বন্যা পরিস্থিতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে ২৮ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। এর মধ্যে কয়েকটি জেলা গত ২-৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত ২৫ জেলার মানুষ সর্বনিু এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ ধরে বন্যার সঙ্গে লড়ছেন।
লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহায়-সম্বল নিয়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ বা উঁচু স্থানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ বা নৌকায় আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন পানিতে ভাসছেন। বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চার জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা :পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দেশের ২৩টি পয়েন্টে প্রধান নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি কমতে শুরু করলেও ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে ১১৩ সেন্টিমিটার, ফুলছড়ি, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি যথাক্রমে বিপত্সীমার ১৪৮, ১২৬, ১২১ ও ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে গঙ্গা ও পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যার অবনতি হতে পারে। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাঁচজনের মৃত্যু, নিখোঁজ একঃ গাইবান্ধায় বন্যায় গতকাল জহুর আলী (৪০) ও মুন্নী খাতুন (১০) নামে আরো দুজন মারা গেছে। এ নিয়ে জেলায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ জনে। এছাড়া সোলেমান আলী (৬৫) নামে একজন বন্যার পানির স্রোতে নিখোঁজ হয়েছেন। জহুর আলী সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চারিতাবাড়ী গ্রামের ফরমান আলীর ছেলে এবং মুন্নী খাতুন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল শ্রমিক কলোনির বাসিন্দা মনু মিয়ার মেয়ে। নিখোঁজ সোলেমান আলী গোবীন্দগঞ্জ উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের কিশামত দুর্গাপুর গ্রামের মৃত কাদের বক্সের ছেলে। একই দিন সকালে কুড়িগ্রামের উলিপুরে বন্যার পানিতে ডুবে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। উলিপুর পৌরসভার জোনাইডাঙ্গা ওয়ার্ডে খাওনার দরগা গ্রামের ভাটিয়াপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত সীমা খাতুন ঐ গ্রামের সাদেক মিয়ার মেয়ে। এছাড়া গতকাল জামালপুরে বন্যায় দুজন মারা গেছেন। তারা হলেন ইসলামপুরের চিনাডুলী ইউনিয়নের বৈলেগাঁও ফৈয়লেমারী গ্রামের ছামিউল মণ্ডলের ছেলে প্রতিবন্ধী মশিউর রহমান (৩০)। মশিউর ঘরের ভেতরে মাচা থেকে পড়ে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন। বকশীগঞ্জের বগারচর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে আবু বক্কর। তিনি মাছ ধরতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বন্যাকবলিত বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল কম। গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বিপদে পড়েছে বন্যার্তরা। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধায় বাঁধ ভেঙে নতুন করে দুটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জে বাঙালি নদীর বাঁধ ভেঙে ১০ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। বন্ধ রয়েছে ৩৬৯টি বিদ্যাপীঠ। এ জেলার ২৫৩টি গ্রামের ৪ লাখ মানুষকে শুধু নিজের জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে। গবাদি পশু আর নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে তাদের কেউ আশ্রয় নিয়েছে পাউবোর বাঁধে, সড়কে, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে ও নৌকায় এবং আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। অনেকে এখনো আটকা পড়ে আছে বন্যার পানিতে।
কুড়িগ্রামে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। এখনো ঘরে ফিরতে পরছে না দুর্গতরা। বন্যায় গত ১০ দিনে ৫৭টি ইউনিয়নের ৮৯৪টি গ্রামের প্রায় ২ লাখ পরিবারের ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। গতকাল বন্যাকবলিত কুড়িগ্রাম এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। এ জেলায় বন্যায় ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা, ৪০ কিমি বাঁধ ও ৪১টি ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬৪ হাজার মানুষ ১৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। গাইবান্ধাও পরিদর্শন করেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর।
জামালপুরের ৭টি উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯ ইউনিয়ন এবং ৮টি পৌরসভার মধ্যে ৭টি পৌরসভা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এ জেলায় ৯০ হাজার পরিবারের কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে আটকা পড়েছে। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। হাজারেরও বেশি বিদ্যাপীঠ বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে গতকাল ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর এবং পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণের কথা থাকলেও তারা হেলিকপ্টারযোগে এসেও ইসলামপুর সরকারি কলেজ মাঠে নামতে পারেননি।
সিরাজগঞ্জ সদরসহ কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালিতে বন্যার সামান্য উন্নতি হয়েছে। এ জেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে ভেঙে যাওয়া টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক মেরামতের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সেনাবাহিনী ও পাউবো যৌথভাবে জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ শুরু করেছে। এর আগে বৃহস্প?তিবার রা?তে ভূঞাপুর-তারাকা?ন্দি সড়ক হিসেবে ব্যবহূত নলীন-পিংনা-যোকারচর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙে যায়। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ জেলায় ৬৬ হাজারেরও অধিক মানুষ পানিবন্দি। যমুনার ভাঙনে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের চরকাটারী ইউপির উত্তরখণ্ডের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় তিন শতাধিক বাড়ি। বিলীন হয়েছে স্কুল, মাদরাসাসহ শত শত বিঘা ফসলি জমি।
রেল চলাচলে বিঘ্নঃ গতকাল বিকাল পর্যন্ত সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলরুটে রেল যোগাযোগ চালু হয়নি। সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলরুটের গাইবান্ধা সদর উপজেলার ত্রিমোহিনীতে রেলপথের প্রায় ৬ কিলোমিটার অংশ ডুবে থাকায় গত বুধবার সকাল ১১টা থেকে এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেল স্টেশন থেকে সান্তাহার এবং গাইবান্ধা রেলস্টেশন থেকে লালমনিরহাট ও দিনাজপুরের মধ্যে ট্রেন চলাচল করছে। অপরদিকে গাইবান্ধা জেলা শহরের সঙ্গে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গাইবান্ধা-বালাসি সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।