খবর ৭১ঃ নবজাতক শিশুর হৃদরোগ, হৃৎপিণ্ড এবং রক্তবাহক সম্পর্কিত রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নুরুন নাহার ফাতেমা। যিনি বাংলাদেশে প্রথম শিশু হৃদরোগ সার্জারি হিসেবে পথপ্রদর্শকের কাজ শুরু করেন।
সফলতার সঙ্গে প্রায় ৬ হাজার হৃদরোগ শিশুর চিকিৎসা করেছেন। এ বছর চিকিৎসাক্ষেত্রে অবদান রাখায় দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য এ ধরনের সর্বোচ্চ সম্মাননা দেশে প্রথমবার তিনিই পেলেন। ডা. ফাতেমাকে বাংলাদেশের ‘মাদার অব পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট’ বলা হয়।
সম্প্রতি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল প্রশাসনিক ভবনে সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ডা. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুন নাহার ফাতেমা জানালেন, যে ‘স্বাধীনতা পদক’ তিনি পেয়েছেন, তার জন্য শোকরিয়া আদায় করেছেন। মানুষের ভালোবাসা তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। শিশুর জন্মগত হৃদরোগ সারিয়ে তোলার পর যে আনন্দ পান, তা সব আনন্দের চেয়ে বহুগুণ বড়। এ পেশা শুরুর পর বিদেশের মাটিতে প্রশিক্ষণরত থাকার সময় কঠিন এক মুহূর্ত পাড় করেছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকাসহ বহুদিন আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে বেঁচে যাওয়ার পর পণ করেছিলেন, চিকিৎসাসেবায় ফিরে পাওয়া জীবন বিলিয়ে দেবেন জনসেবায়। বিনামূল্যে শিশুদের চিকিৎসা করবেন। ডা. ফাতেমা শিশু চিকিৎসার আরেক প্রতিকৃত অধ্যাপক ডা. এমআর খানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশ’। তার মা-বাবার নামে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়াদুদ-ময়মুন্নেছা ফাউন্ডেশন’। যে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ফ্রি চিকিৎসাসেবাসহ ওষুধ দিয়ে আসছেন তিনি।
১৯৮৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তিনি দেশের প্রথম পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট। তার স্বামী কর্নেল (অব.) আজহারউদ্দিন আহমেদ। জন্ম সিলেট জেলার মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাকশাইল গ্রামে। ডা. ফাতেমা জানান, এ পর্যন্ত কোনো কাটাছেঁড়া ছাড়াই ৬ হাজারেরও বেশি শিশুর জটিল হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।
১৯৯৭-৯৮ সালে সৌদি আরবের কিং সুলতান হাসপাতালে বিভিন্ন বিদেশি চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে দেশে ফিরে এসে ১৯৯৮ সালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শিশু হৃদরোগ বিভাগ, যা দেশের প্রথম শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র।
২০০০ সালে পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী দুই দিনের শিশুকে নিয়ে আসেন ডা. ফাতেমার কাছে। ওই সময় তিনি চেম্বার করছিলেন। শিশুটিকে দেখে তিনি তাৎক্ষণিক বুঝতে পারেন চরম হৃদরোগে ভুগছে শিশুটি। শিশুটির সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। রক্তনালির সমস্যায় ভুগছিল শিশুটি। পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় শিশুটির হার্টে ছিদ্র করে দেন তিনি।
এতে বেঁচে যায় শিশুটি। তিনি শিশুটির নাম শতাব্দী রেখেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সন্তানের হার্টের একটি রক্তনালি ছিল না। শিশুটির মাত্র ২ দিন বয়স ছিল। তার চিকিৎসা করেন তিনি। এভাবে শত শত শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন এ চিকিৎসক।
ডা. ফাতেমা জানান, শিশু হৃদরোগের লক্ষণগুলো প্রতিটি পরিবারের সদস্যেরই জানা দরকার। নবজাতক নীল হয়ে গেছে, শ্বাসকষ্ট শুরু হলে এবং অল্প বেস্ট ফিডিং করার পরই হাঁপিয়ে গেলে তাকে দ্রুত শিশুরোগ বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, দেশে প্রতি হাজারে ২৫টি শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে হৃদরোগ নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা ৮-১০ জন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, একসময় শিশুর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনকে বিশ্বাস করানোই যেত না শিশুর হৃদরোগ হতে পারে। ছোট্ট একটা হৃদপিণ্ডে আবার কিসের ‘হৃদরোগ’।
দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বপ্রথম ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় মেলোডি পালমোনারি ভাল্ব প্রতিস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে তার মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত ইন্টারভেশনগুলো হচ্ছে- বেলুন এট্রিয়াল সেপটোসটোমি, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস কয়েল অকলুশন, এট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, ভেট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস ডিভাইস ক্লোজার, মাসকুলার ভেট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, করোনারি ফিসটুলা কয়েল অকলুশন, ভেট্রিকুলা সেপটাল ডিফেক্ট ডিভাইস ক্লোজার, পেটেন্ট ডাকটাস আরটারিওসাস ডিভাইস ক্লোজার ইত্যাদি।
ডা. ফাতেমার স্বপ্ন অনেক বড়। দেশের মাটিতে শিশুদের চিকিৎসায় একটি বিশেষায়িত জাতীয় কার্ডিয়াক হাসপাতাল তৈরি করতে চান। যেখানে এসব রোগীর যথাযথ চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে। যেখানে অসচ্ছল মা-বাবার সন্তানরা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবে। তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মার্জিয়া তাবাসসুম ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে লন্ডনে সফল একজন ব্যাংকার হিসেবে চাকরি করছেন। ছোট মেয়ে মাশিয়া মাইশা আহমদ। মেডিসিনের ওপর ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন।