নড়াইলের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরব গাঁথায় এক উজ্জ্বলতম নাম মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন!

0
546

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নড়াইলের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথায় রতœখচিত আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আনোয়ার হোসেন। ঘটনার আকস্মিকতা কিংবা পারিপার্শ্বিকতার চাপে নয়, আজন্ম লালিত স্বপ্ন এবং বিশ্বাসের বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা মুক্তি সংগ্রামে দৃঢ়চিত্ত ও সুস্থির সিদ্ধান্তে পাক-বাহিনীর মোকাবেলায় নেমেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়ের রিপোর্টে, শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) ছিল এই মহান মুক্তিযোদ্ধার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। মিষ্টভাষী, পরোপকারী,অসাম্প্রদায়িক, নির্লোভী ও একবারেই সাদামনের মানুষ ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বীর সেনানী মো.আনোয়ার হোসেন ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। নীতিতে ছিলেন অটল, যিনি মানুষকে ভালবাসতেন, সম্মান দিতেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এক কথায় যাকে বলে মানবদরদী। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান-ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিল স্বচ্ছতা ও সততার সৌরভে উদ্ভাসিত। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় এলাকাবাসী তাঁকে ‘মিয়া ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৪৮ সালের ৮ জুন বৃহত্তম যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমানে জেলা) কালিয়া উপজেলার চাঁচুড়ী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন মুক্তিযোদ্ধা মো: আনোয়ার হোসেন। সমাজের যে কোন অন্যায়- অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল কঠোর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে স্থানীয়ভাবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতেন। ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো / বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ সেøাগানে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর নড়াইল শহরকে হানাদার মুক্তকরার জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রুপ কমান্ডার আমির হোসেনের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তাানি সেনাদের সঙ্গে তাঁদের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। এই সম্মুখ যুদ্ধটি ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। প্রায় ৪ ঘন্টা যাবত তাঁদের তুমুল গুলি চালাতে হয়। রাত ৩টার দিকে মো.আনোয়ার হোসেনের ঠিক ডান পাশে অবস্থানরত সহযোদ্ধা বাগডাঙ্গা গ্রামের মতিয়ার রহমান আর ইহলোকে নেই, পাক সেনাদের গুলি খেয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। নড়াইল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পনে অস্বীকার করেন। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চর্তুদিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুর করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের আটক করা হয়। মো: আনোয়ার হোসেনের বাবা ছিলেন মরহুম আবুল কাশেম মোল্যা ও মাতা রওশনারা বেগম। পিতা ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। সদ্য সমাপ্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাবে জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ পরিক্রমায় তাঁর শিক্ষা জীবন বেশি দূর না এগোলেও তিনি ১৯৭২ সালে নড়াইল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। তিনি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর ৮ নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ.মনজুর অধীনে স্থানীয় কমান্ডার আমীর হোসেনের নেতৃত্বে মো: আনোয়ার হোসেন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। বীরত্বের সাথে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর দলটি কুশলতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তিনি বাগডাঙ্গা, ছাগলছড়ি, আটলিয়া, বারইপাড়া ও কালিয়াসহ নড়াইলের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তিনি। রণাঙ্গনের সফল এই যোদ্ধা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে ২৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবশেষে অসম্ভব গুণী এই মানুষটি ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কারণে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম স্থান চাঁচুড়ী গ্রামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাঁকে। আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-বৈষম্য-অসাম্য-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকা এবং জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এই মহান মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি■ ছবি সংযুক্ত-১৩.১২.১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here